সুরক্ষা: ভয় ধরাচ্ছে ডেঙ্গি। মঙ্গলহাটের মোটবাহকেরা তাই বিপদ থেকে বাঁচতে ব্যবহার করছেন মশারি। রবিবার রাতে, হাওড়া ময়দানের কাছে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
বিগত কয়েক বছরের মতো এ বারও প্রথম থেকেই ডেঙ্গির তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন মহলে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হলেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছে। গত বছর খোদ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী রাজ্যের বিরুদ্ধে মশাবাহিত এই রোগের তথ্য না জানানোর অভিযোগ তুলেছিলেন। আর এ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়েবসাইটেই নেই রাজ্যের ডেঙ্গি-তথ্য। পরিসংখ্যানের বদলে সেখানে লেখা রয়েছে ‘এনআর’, অর্থাৎ সেটি রেকর্ডে নেই!
অভিযোগ, চলতি বছরে ডেঙ্গির কোনও তথ্যই প্রকাশ্যে আনতে রাজি নয় রাজ্য। আগে সাপ্তাহিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হত। প্রতিটি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে তা পাঠানো হত। কিন্তু এ বার তা করা হচ্ছে না বলেই সূত্রের খবর। এ দিকে, পরিস্থিতি ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে ওঠায় তিন-চার দিন অন্তর জরুরি বৈঠকে বসছে রাজ্য প্রশাসন। সেখানে বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হচ্ছে। রীতিমতো বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোথাও এই মরসুমে, অর্থাৎ, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা জানানো হচ্ছে না। এমনকি, অগস্ট থেকে ডেঙ্গির সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হতেই স্থানীয় পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতরের চাপে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারগুলিও। অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্টেও ডেঙ্গি লেখা হচ্ছে না। যদিও প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের দাবি, ডেঙ্গি পজ়িটিভ রিপোর্ট ঠিক মতো না জানালে পরীক্ষাগারের লাইসেন্স বাতিল হবে বলে জানানো হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘তথ্য গোপনের স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে কেন্দ্রের পোর্টাল দেখলেই। জনস্বাস্থ্যের নিরিখে সেখানে কেন পরিসংখ্যান থাকবে না?’’
‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ভেক্টর বোর্ন ডিজ়িজ় কন্ট্রোল’-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেশের ডেঙ্গি পরিস্থিতির দিকে নজর রাখলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ থেকে শুরু করে ২০২২ পর্যন্ত ৩৬টি রাজ্যের মোট ডেঙ্গি আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যান রয়েছে। পাশাপাশি, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যারও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের কোনও তথ্য নেই। এ বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত এ রাজ্য বাদে বাকি ৩৫টি রাজ্য মিলিয়ে মোট আক্রান্ত ৩১ হাজার ৪৬৪ জন। মৃতের সংখ্যা ৩৬। বেসরকারি সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ রাজ্যে জুলাই পর্যন্ত আক্রান্তের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। ২৯ জুলাই পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল নয়। কিন্তু এর কোনওটাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পোর্টালে নথিভুক্ত করা হয়নি। যদিও গত বছরের নিরিখে চলতি বছরে ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
বিস্মিত চিকিৎসকদের প্রশ্ন, ‘‘এই তথ্য গোপন কার স্বার্থে করা হচ্ছে? প্রতি বারই কি তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার এমন প্রবণতা চলতে থাকবে?’’ এই মুহূর্তে ডেঙ্গি নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে রাজি নন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শীর্ষ কর্তা বললেন, ‘‘সব তথ্যই জানানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জায়গায়। কিন্তু কেন্দ্রের পোর্টালে কেন তথ্য তোলা হয়নি, বলতে পারব না।’’ তথ্য না তোলার নেপথ্যে ‘গভীর চক্রান্ত’ রয়েছে বলেই দাবি ‘সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাসের। তাঁর দাবি, ‘‘এটা জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান-বিরোধী কাজ। যে কোনও রোগের মোকাবিলা করতে হলে সবার আগে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা যাচ্ছেন, তার প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা দরকার। না-হলে কোনও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় না।’’
প্রথমে ‘অজানা জ্বর’, তার পরে ‘বাংলাদেশ থেকে আসছে’ এবং এখন তথ্য গোপন করে ‘ভাল আছি’ প্রমাণ করার চেষ্টা— এই তিনটি স্তরেই রাজ্য প্রশাসন মিথ্যাচার করছে বলে অভিযোগ ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটার। তিনি বলেন, ‘‘এমন মিথ্যাচার করে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরাও দিশাহীন। মানুষও সচেতন হচ্ছেন না। বিপদ আরও বাড়ছে।’’