অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
একটি দলের নেতা বলছেন, তাঁরা আর মিডিয়ার উপর নির্ভর করেন না। আর বাংলার রাজনীতিতে বর্তমানে সে দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বলছে, মিডিয়া সেলকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। যে কোনও ইস্যুতে দলের বার্তা দ্রুত মিডিয়ায় তুলে ধরতে ‘পকেট স্টুডিয়ো’ বানানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।
নজরুল মঞ্চে গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল কনক্লেভের আয়োজন করেছিল তৃণমূল। দলের ডিজিটাল সেল যাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে কাজ করছে, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডিজিটাল কনক্লেভে বলেছিলেন, তৃণমূল আর কোনও মিডিয়ার উপরে নির্ভর করে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ইতিবাচক কাজকর্ম তুলে ধরার বিষয়ে মিডিয়ার একাংশের অনীহা রয়েছে বলেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই কারণেই মিডিয়ার উপরে নির্ভর না করে দলের সাইবার সৈনিকদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি। দল ও সরকারের যাবতীয় ইতিবাচক কাজ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সোশ্যাল মিডিয়া সেল বা ডিজিটাল সেলকেই— বার্তা দিয়েছিলেন অভিষেক।
কিন্তু বিজেপি ঠিক উল্টো কথা বলছে। রাজ্য বিজেপি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মিডিয়াকে আমরা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ বলে মনে করি। গণতান্ত্রিক রাজনীতি করব আর মিডিয়ার উপরে নির্ভর করব না, এ রকম কথা আমরা বলতে পারি না। মিডিয়া সেলকে যে চেহারা দেওয়ার পরিকল্পনা আমরা করেছি, এ রাজ্যে কোনও রাজনৈতিক দল আগে সে রকম করেনি।’’
কী পরিকল্পনা বিজেপি-র? রাজ্য কমিটির তরফে মিডিয়া সামলানোর দায়িত্বে থাকা সপ্তর্ষি চৌধুরী জানালেন, এত দিন রাজ্য বিজেপি-র কর্মসূচিগুলোর বিষয়েই মূলত মিডিয়াকে অবহিত করা হত। এ বার একই কায়দায় জেলা স্তরে বা আরও নীচের স্তরের কর্মসূচিও জেলার সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
রাজ্য বিজেপি-র কোন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কোথায় কী কর্মসূচিতে থাকছেন, মিডিয়া সেলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তা জানিয়ে দেওয়া হয় নিয়মিত। রাজ্য বিজেপি-র সদর দফতরে কোনও সাংবাদিক বৈঠক হলেও মিডিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ওই হোয়াসঅ্যাপ গ্রুপেই। বিজেপি-র মিডিয়া সেলের প্রতিনিধিরাও সাংবাদিক সম্মেলনের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করেন। তার পরে সেই ভিডিয়ো ইউটিউবে আপলোড করে তার লিঙ্ক দিয়ে দেওয়া হয় মিডিয়া সেলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটিতে।
আরও পড়ুন: বিজেপিতে যোগ দিতে হবে, জানতেনই না ওঁরা!
ঠিক এই পদ্ধতিই এ বার প্রতিটি জেলাতেও চালু করতে চাইছে বিজেপি। জেলা স্তরের কোনও কর্মসূচির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার মিডিয়াকে দ্রুত অবহিত করা, জেলা নেতাদের সাংবাদিক বৈঠক ইউটিউবে আপলোড করা এবং লিঙ্ক পাঠিয়ে দেওয়া— এই ভাবে জেলা স্তরেও মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে গেরুয়া শিবির। জেলার প্রতিবেদকদের কাছে দলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মসূচির খবরও পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব? মাত্র দু’মাস আগে দলের মিডিয়া সেলকে নিয়ে রাজ্য দফতরে বৈঠকে বসেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা শিব প্রকাশ। ৩৭টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ২৩টির প্রতিনিধিরা বৈঠকে হাজির হন, অনুপস্থিত ছিল ১৪টি জেলা। শিব প্রকাশ তা নিয়ে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন বলে বিজেপি সূত্রেই জানা গিয়েছিল। সংগঠনের হাল যদি এই রকম হয়, তা হলে রাজ্য কমিটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেলা স্তরের যে কোনও কর্মসূচিও মিডিয়ার কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা কী ভাবে বাস্তবায়িত হবে? বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিজেপি-র অন্দরেও।
তবে বিজেপি-র মিডিয়া সেল বলছে, সংগঠনের ওই চেহারাটা দু’মাস আগের। শিব প্রকাশ ৮ জুলাইয়ের বৈঠকে সতর্কবার্তা দেওয়ার পর থেকেই দ্রুত বদলেছে পরিস্থিতি। ৩৭টি জেলা কমিটিকেই সক্রিয় করে তোলা গিয়েছে। এবং খুব শীঘ্রই রাজ্য কমিটির ঢঙেই মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা শুরু করবে তারা।
তবে বিজেপি মিডিয়া সেলের ‘ব্লকবাস্টার’ পরিকল্পনা হল ‘পকেট স্টুডিয়ো’। কী সেটা? সেটা হল, দলের রাজ্য দফতরেই ছোটখাটো একটা স্টুডিয়ো বানিয়ে ফেলা। কেন এই ‘পকেট স্টুডিয়ো’ বানানোর কথা ভাবল বিজেপি? মিডিয়া সেলের শীর্ষকর্তার ব্যাখ্যা— ‘‘এখন রাজ্যে অনেক চ্যানেল, অনেক ওয়েবসাইট। সবার কাছে দলের বক্তব্যটা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। সকলেই চান নিজেদের স্টুডিয়ো বা নিউজরুমে সুবক্তাদের হাজির করতে। অনেক সময় একই নেতাকে অনেকগুলি মিডিয়া ডাকে। সময় হয়তো আলাদা আলাদা, কিন্তু এক জায়গায় আলোচনা শেষ হচ্ছে যে সময়ে, ঠিক সেই সময়েই অন্য জায়গায় শুরু হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সর্বত্র পৌঁছনো সম্ভব হয় না। আমাদের যদি একটা পকেট স্টুডিয়ো থাকে, তা হলে এই সব ক্ষেত্রে দলের মুখপাত্রদের কোথাও যেতে হবে না। রাজ্য দফতরের বসেই পর পর বিভিন্ন মিডিয়ায় দলের কথা তুলে ধরতে পারবেন তাঁরা।’’
পরিকল্পনা শুনতে ভাল। কিন্তু আদৌ বাস্তবায়িত হবে? রাজ্য বিজেপি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র সায়ন্তন বসু বললেন, ‘‘অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আমরা মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্কের উপরে খুব জোর দিচ্ছি। যত বেশি সম্ভব কভারেজের বন্দোবস্ত করার পন্থা-পদ্ধতি নিয়েও ক্রমাগত আলোচনা চালাচ্ছি।’’ সায়ন্তন জানালেন, এ আলোচনা রাজ্য স্তরের নয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ছকে দেওয়া রণকৌশল অনুযায়ীই মিডিয়ায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে রাজ্যের সংগঠন। তাই রাজ্য দফতরে পকেট স্টুডিয়ো থেকে জেলায় জেলায় মিডিয়া টিম— কোনও পরিকল্পনার রূপায়ণেই সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলে তাঁর মত।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে বাইক এখন টোল-ফ্রি
সায়ন্তন বসু, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বা সপ্তর্ষি চৌধুরীরা যা-ই বলুন, বিজেপি-র মিডিয়া স্ট্র্যাটেজির সাফল্য নিয়ে সংশয় কিন্তু রয়েছে বিজেপি-র অন্দরেই। খুব স্পষ্ট ভাবে ধরা দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ বিভাজনের ছায়াও। দলের এক রাজ্য নেতা বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘‘সুবক্তা হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের আজকাল বলতেই দেওয়া হয় না। বিভিন্ন মিডিয়ার প্যানেলে রোজ এমন এমন লোককে পাঠানো হচ্ছে, যাঁরা ঠিক মতো কথাই বলতে পারেন না। পকেট স্টুডিয়ো কোন কম্মে লাগবে!’’
যে নেতা এই মন্তব্য করলেন, তিনি নিজে কিন্তু সুবক্তা হিসেবেই পরিচিত। বিজেপি-র জনপ্রিয় মুখগুলির অন্যতম হিসেবেও পরিচিত তিনি। তাঁর সক্ষোভ প্রশ্ন, ‘‘দল যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল না, রাজ্যেও সে ভাবে ভোট পেত না, তখন ক’জনকে ডাকত মিডিয়া? আমরা কয়েক জন নিজেদের কৃতিত্বে সে সময়ে মিডিয়ার সঙ্গে দলের যোগসূত্র ধরে রেখেছিলাম। এখন সক্ষমতা হয়েছে, স্টুডিয়ো তৈরির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সে স্টুডিয়োয় যাঁরা বসবেন, তাঁরা আদৌ কথা বলতে পারবেন তো? তাঁদের কথা শুনতে কেউ আগ্রহী হবেন তো? সেটা আগে ভেবে নেওয়া দরকার।’’
(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া - পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)