আব্বাস সিদ্দিকি এবং সংখ্যালঘু নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। —নিজস্ব চিত্র।
নির্বাচন ঘিরে বাংলায় কাজ শুরু করে দিয়েছে দল। আসন্ন নির্বাচনে আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বেই বাংলায় লড়বেন তাঁরা। ফুরফুরা শরিফে এসে জানিয়ে দিলেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাংলায় আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বেই এগিয়ে যাব আমরা। ওঁর পাশে থাকব আমরা। উনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাকেই সমর্থন করব।’’
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (মিম) প্রধান ওয়াইসির এই বাংলা সফরকে যদিও গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল। দলের সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘‘আসাদউদ্দিন তো আগেই বাংলায় আসবেন বলে জানিয়েছিলেন। আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে এই বৈঠক নতুন ব্যাপার। ওয়াইসি বুঝতে পেরেছেন, বাংলায় তাঁর কোনও প্রভাব পড়বে না। কারণ বাংলায় উর্দুভাষী মুসলমানের সংখ্যা কম। তাই ফুরফুরায় আব্বাস সিদ্দিকির আত্মীয়দের কাছে গিয়েছেন।’’ বিজেপির ভোট কাটানোই মিমের লক্ষ্য, বাংলার মানুষ কখনও তাদের গ্রহণ করবেন না এবং মিমের আগমনে বাংলার রাজনীতিতে কোনও প্রভাব পড়বে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কিন্তু বিজেপির ‘বি’ টিম হিসেবে কাজ করার অভিযোগ উড়িয়ে দেন ওয়াইসি। সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের নিয়ে যদি এতই চিন্তা, তাহলে গুজরাত যখন জ্বলছিল, কোথায় ছিলেন মমতা? উনি নিজেই তো বিজেপি-কে আটকাতে পারছেন না। এত লোক তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যাচ্ছেন, তাঁদের আটকাতে পারছেন না কেন? আসলে বিজেপি-র হাত শক্ত করেছে তৃণমূলই। গত লোকসভা নির্বাচনে তো বাংলায় লড়েনি মিম। তা সত্ত্বেও বিজেপি ১৮টা আসন পেল কী ভাবে?’’
আরও পড়ুন: বাগুইআটিতে উদ্ধার বার ডান্সারের দেহ, বেপাত্তা পুরুষ সঙ্গী
তবে যে বিজেপির হয়ে ভোট কাটার অভিযোগ মিমের বিরুদ্ধে, এ রাজ্যে তাদের সহ সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ নির্বাচনে নাম লেখাতেই পারেন। তবে ওটা একটা ধর্মীয় সংগঠন। বাংলায় মিম তেমন কোনও বড় ফ্যাক্টর নয়।’’
এ দিকে ফুরফুরা শরিফের আর এক পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির গলায় কিন্তু অন্য সুর। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ত্বহা মিমের সঙ্গে আব্বাসের এই ‘সমঝোতা’র বিপক্ষেই মুখ খুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ফুরফুরা শরিফ বা বাংলার মানুষ সমর্থন করবে না।ফুরফুরা শরিফের পীরজাদারা ধর্মগুরু। শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দেন। কখনও সরাসরি রাজনীতি করেন না। মুসলিম ভোট ভাঙানোর জন্য বিজেপি টাকা ছড়িয়ে এ সব করছে। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হবে না। বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবেন না।’’
রবিবার সাতসকালে দমদম বিমানবন্দরে পা রাখেন অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (মিম) প্রধান আসাদউদ্দিন। সেখান থেকে সোজা ফুরফুরা শরিফের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। সেখানে পীরজাদা আব্বাস, পীরজাদা নৌশাদ সিদ্দিকি, পীরজাদা বইজিদ আমিন এবং সাবির গফ্ফর-সহ সংখ্যালঘু নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। আসাদউদ্দিনকে ফুরফুরা শরিফ ঘুরিয়েও দেখান আব্বাস। সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায় আসাদউদ্দিনকে।
’২১-এর নির্বাচনে বাংলায় প্রার্থী দেবেন ঘোষণা করে আগেই চমকে দিয়েছিলেন আসাদউদ্দিন। রবিবার সকালে আচমকা হুগলির ফুরফুরা শরিফে আব্বাসের সঙ্গে তাঁর দেখা করতে যাওয়া নিয়েও তাই জল্পনা শুরু হতে সময় লাগেনি। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, সংখ্যালঘু ভোটকে একসুতোয় গাঁথতেই কি দু’জনের এই সাক্ষাৎ? কারণ আলাদা দল গড়ে নির্বাচনে নাম লেখাবেন বলে সম্প্রতি ঘোষণা করেছিলেন আব্বাস। তার পরই মিমের তরফে তাঁকে নিয়ে সক্রিয়তা শুরু হয়ে যায়। নিজের এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে আব্বাসের। তাঁকে দলে টানতে পারলে বিহারের পর পূর্ব ভারতের আরও একটি রাজ্যে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেওয়া যাবে বলে নিশ্চিত ছিলেন মিম নেতৃত্ব। এ রাজ্যে মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ১৩৭টি আসনই তাঁদের নজরে।
ফুরফুরা শরিফ ঘুরে দেখছেন আসাদউদ্দিন। —নিজস্ব চিত্র।
আব্বাসকে পাশে পেতে এর আগে বাম এবং কংগ্রেস জোটের তরফেও চেষ্টা চালানো হয়। ফুরফুরা সরিফে গিয়ে দুই দলের শীর্ষ নেতারা আব্বাসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আশা ছিল, আব্বাসের সমর্থন পেলেও কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবেন তাঁরা। কিন্তু এ দিন আসাদউদ্দিন-আব্বাস বৈঠকের পর সেই সম্ভাবনা কার্যত আর রইল না। কিন্তু আব্বাস মিমে যোগ দেবেন, নাকি নিজের আলাদা দল গড়ে মিমের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়বেন, সেদিকেই এখন তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। আব্বাসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এ দিন টুইটও করেন ওয়াইসি। তবে বাংলায় দলের রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে তাতে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি।
আচমকা বাংলা আসাদউদ্দিনের আগমন নিয়ে প্রশ্ন করলে, রাজ্যে মিমের সভাপতি জামিরুল হাসান জানান, জানুয়ারিতে আসাদউদ্দিন বাংলায় আসছেন, তা আগে থেকেই ঠিক ছিল। নিজে থেকেই ফুরফুরা শরিফে গিয়েছেন তিনি। এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গে রয়েছেন জামিরুল। ফুরফুরা শরিফে তিনি আসাদউদ্দিনের সঙ্গী হতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাংগঠিনক কাজকর্ম ছেড়ে তাঁকে নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন আসাদউদ্দিন। তাই এ দিন ফুরফুরা শরিফে মিমের রাজ্য নেতৃত্বের তেমন কোনও বড় মুখকেই দেখা যায়নি। রবিবার বিকেলের বিমানেই ফের দিল্লি ফিরে যাওয়ার কথা আসাদউদ্দিনের।
আরও পড়ুন: ক্রিকেট-স্বাস্থ্য দেখতে গিয়ে নিজের শরীরের খেয়াল রাখেননি সৌরভ
সংখ্যালঘু ভোটকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এলেও, পরবর্তী কালে রাজনৈতিক দলগুলি সংখ্যালঘু মানুষদের তেমন গুরুত্ব দেয় না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ আসাদউদ্দিনের। তাই শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের সর্বত্র দলের ভিত মজবুত করতে সক্রিয় হয়েছেন তিনি। তবে বঙ্গ নির্বাচনে প্রার্থী নামানোর সিদ্ধান্তের জেরে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। সম্প্রতি কোচবিহার সফরে গিয়ে আসাদউদ্দিনের পোস্টার দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘মিম হায়দরাবাদের পার্টি। বিজেপির ‘বি’ টিম ওরা। ওদের সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করতে দেবেন না।’’
মমতার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান আসাদউদ্দিনও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কারও টাকা নিয়ে কাজ করি না। মমতা যেন অন্য দলের সঙ্গে আমাদের না গুলিয়ে ফেলেন।’’ এই তরজার মধ্যেই দিন কয়েক আগে বাংলায় মিমের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা শেখ আনোয়ার হুসেন তৃণমূলে যোগদান করেন। তিনি ছাড়াও আরও বেশ কয়েক জন নেতা মিম থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তা নিয়ে অসন্তুষ্ট জোড়াফুল শিবিরের অনেকেই। তার মধ্যেই বাংলায় আসাদউদ্দিনের এই আগমন। রবিবার বিকেলে বড়ঞা ব্লক তৃনমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কুলিতে একটি জনসভায় যোগদান করতে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী তথা কলকাতা পৌরসভার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘মিমের এসব করে কোনও লাভ নেই। ‘পলিটিক্স অফ পোলারাইজেসন’ এখানে চলে না। এ বিবেকানন্দের বাংলা।’’