দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের পরিস্থিতি এখন ভয়ঙ্কর। জনসংখ্যাবৃদ্ধি এবং মারাত্মক খরার প্রভাবে সেখানকার লোকেরা এখন ‘শূন্য দিন’-এর আশঙ্কায় দিন গুনছেন। ‘শূন্য দিন’ বলতে বোঝাচ্ছে সেই দিনটিকে, যে দিন জলের অভাবে সমস্ত শহরবাসীর এবং সমস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কল থেকে জল পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। কেপটাউনের পুরকর্তাদের মতে এ বছর জুলাই মাসেই আসতে চলেছে সেই ভয়ঙ্কর দিন।
‘ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট, ২০১৮’ বলছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা আনুমানিক আরও দু’শো কোটি বাড়তে চলেছে। জলের চাহিদা বাড়বে আরও ৩০ শতাংশ। অন্য দিকে, বর্তমানে মোটামুটি ১৯০ কোটি লোক এমন এলাকায় বাস করেন, যেখানে জল দুর্লভ। ২০৫০ সালে এমন জল-দুর্লভ এলাকায় বসবাসকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩০০ কোটিতে। সুতরাং, সারা পৃথিবীই চরম জলসঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আর এই জলসঙ্কট নিরসনে কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছর ২২ মার্চ দিনটিকে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘আন্তর্জাতিক জলদিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।
জলধারণ ও জলবণ্টন
ভারতে জলধারণ ও বণ্টন পরিকল্পনার সূত্রপাত ১৯৪৫ সালে ‘কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল বোর্ড’ তৈরির মধ্যে দিয়ে। ২০১৫ সালে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার জল পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজার জন্য মিহির শাহের নেতৃত্বে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি নিয়োগ করে। এই কমিটি সুপারিশ করেছে জাতীয় জল কমিশন গঠনের। প্রস্তাবিত জল কমিশন খতিয়ে দেখবে, নদীর জল বা ভৌম-জলকে কত পরিমাণে খরচ করা যেতে পারে। এ সব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জলসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে উপায় এবং লক্ষ্যের নিরিখে ভাবতেই অভ্যস্ত। কিন্তু জল ব্যবস্থাপনার সমস্যাটি জটিল। একে ঠিক করে বুঝতে গেলে ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যেই বুঝতে হবে।
ভারতের মতো দেশে যেখানে সেচ-নির্ভর কৃষিতে ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা প্রবল, সেখানে জল-নিয়ন্ত্রণ একটা ক্ষমতার অঙ্গীকার এনে দেয়। উত্তরকূট পর্বতমালা থেকে শিবতরাইয়ের সমভূমিতে নেমে আসা মুক্তধারাকে বাঁধ দিয়ে শিবতরাইয়ের কৃষিজমিকে কী ভাবে উত্তরকূটের রাজা ঊষর করে দিয়েছিলেন এবং তার পরে রাজার পালিতপুত্র অভিজিৎ প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে সেই বাঁধ ভেঙে কী ভাবে সেই জলধারাকে মুক্ত করেছিলেন— তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশো বছর আগেই লিখে গিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদ কার্ল অগস্ট উইটফোগেল তাঁর ‘প্রাচ্যের স্বেচ্ছাচার’ (১৯৫৭) বইয়ে জানিয়েছিলেন, যে সমাজে সেচ ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের আওতাধীন, সেখানে সরকারের প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক ক্ষমতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। সে ব্যবস্থাকে তিনি ‘জলনির্ভর স্বেচ্ছাচার’ (Hydrolic Despotism) বলে অভিহিত করেছিলেন।
ভারতে সেচ ব্যবস্থার বিকাশ মূলত রাষ্ট্রনির্ভর। রাষ্ট্রের সেচ ব্যবস্থায় নির্ভর না করে চাষিরা কয়েক দশক ধরে ভূগর্ভস্থ জলের যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করেছেন। নিঃসন্দেহে এই স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার অচিরে শেষ করে দেবে ভূগর্ভস্থ জলসম্পদের ভাণ্ডারকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৫ সালে ভূগর্ভস্থ জল সম্পদের অবাধ ব্যবহার বন্ধ করতে চালু করেছে ‘ভূগর্ভস্থ জলসম্পদ নিয়ন্ত্রণ আইন’। কিন্তু রাজনৈতিক ‘বাধ্যবাধকতায়’ তার প্রয়োগ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে, রাজ্যে আটটি জেলার তিরাশিটি ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলসম্পদে আর্সেনিকের উপস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সুদর্শন আয়েঙ্গারের (রোহিত দেশাই সম্পাদিত গ্রন্থ, ২০০১) লেখা নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালে গুজরাতের আঠারো হাজার গ্রামে পানীয় জলের পর্যাপ্ত উৎস ছিল। কিন্তু ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত নিষ্কাশনের ফলে ২০০১ সালেই উত্তর গুজরাত, সৌরাষ্ট্র ও কচ্ছের পনেরো হাজার গ্রামে সাংঘাতিক জলসঙ্কট শুরু হয়েছে।
জল বিবাদ এবং জলচুক্তি
জল সমাজের সম্পদ। তার উপরে সব মানুষের সমান অধিকার বর্তমান। অথচ, জনজাতির মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি করে জল। প্রয়োজন পড়ে বিবাদমান দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তি করার। অথচ, কাবেরী জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের মধ্যে বিবাদ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও মেটেনি। অন্য দিকে, তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির দাবিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের ১৯৮৩ থেকে কথা চলছে। কী ভাবে এই আন্তর্দেশীয় জল-সমস্যার সমাধান করা যায়, সে চিন্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্লভ জল ও জলশাসন
বোঝা যাচ্ছে, যে জল এখন খুব একটা সুলভ বস্তু নয়। দুর্লভ যে কোনও বস্তুই সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। জনগোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেণিবিভাগ নিরূপণের ক্ষেত্রে জল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আশা করা যায়, জলদিবস পালনের সঙ্গে তৈরি হওয়া সচেতনতা সামাজিক বিভেদ থেকে নিষ্কৃতির উপায় নিয়ে আসবে।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক