গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জল কোন দিকে গড়াবে, কী রং নেবে, কেউ নিশ্চিত করে বলছেন না। কিন্তু বছরভর ধরে জমতে থাকা বরফ যে গলে জল হয়ে গিয়েছে, তার সাক্ষী ‘ভাইফোঁটা’। সাক্ষী ‘বোনফোঁটা’ও।
২০১৮ সালে ভাইফোঁটা যে তারিখে ছিল, সে তারিখে তৃণমূলেই ছিলেন কলকাতার তৎকালীন মেয়র তথা রাজ্যের তদানীন্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু পরম্পরায় ছেদ পড়েছিল, দলনেত্রীর বাড়িতে সে দিন দেখা যায়নি তাঁকে। ২০১৯ সালের ভাইফোঁটা যে তারিখে হল, সে দিন শোভন খাতায়-কলমে বিজেপিতে। কিন্তু তৃণমূলনেত্রীর বাড়ি গিয়ে এ দিন ফোঁটা নিলেন তিনি। শুধু ‘ভাই’ কাননকে নয়, ‘বোন’ বৈশাখীকেও ফোঁটা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার দুপুর ২টো নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পৌঁছন শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘণ্টা দুয়েক থাকেন সেখানে। অত ক্ষণ ধরে মমতার বাড়িতে ঠিক কী করলেন শোভন-বৈশাখী, কী কথা হল— তা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রবল কৌতূহল তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক শিবিরে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। শোভন-বৈশাখীও এ দিন এড়িয়ে গিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎ।
মন্ত্রিত্ব এবং মেয়র পদে শোভন চট্টোপাধ্যায় ইস্তফা দিয়েছিলেন ২০১৮-র নভেম্বরে। তার পর থেকে তিনি আর কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হননি, তৃণমূলের বা সরকারের কোনও কর্মসূচিতে যোগ দেননি। আড়াই মাস আগে দলও বদলে নিয়েছেন। তা হলে আচমকা গোটা রাজনৈতিক শিবিরকে অবাক করে দিয়ে ফোঁটা নিতে ‘দিদি’র বাড়িতে কেন হাজির হলেন কানন? তা-ও আবার বৈশাখীকে সঙ্গে নিয়ে? তা হলে কি পুরনো দলে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল মমতার একদা ‘চোখের মণি’ কাননের? গুচ্ছ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ভাইফোঁটায় মমতার বাড়িতে শোভন-বৈশাখীর এই সৌজন্য সফর।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, এ বারের ভাইফোঁটায় মমতার বাড়িতে শোভনকে হাজির করার নেপথ্যে বৈশাখীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তৃণমূল ছাড়লেও তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি কখনওই। বৈশাখী যে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা, সেই কলেজের কিছু সমস্যা নিয়ে পার্থর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে তিনি বাধ্য হয়েছেন বলে বৈশাখী বরাবরই দাবি করে এসেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক কথা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট মন্তব্যও তিনি সব সময় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ দিন ফোঁটা নিতে মমতার বাড়িতে শোভনের পৌঁছে যাওয়ার নেপথ্যে পার্থ-বৈশাখীর যোগসূত্র সেতুর মতো কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
কয়েক দিন আগেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বৈঠক করে আসেন বৈশাখী। বিজয়ার প্রণাম জানানো এবং কলেজের বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্যই গিয়েছিলেন বলে বৈশাখী জানিয়েছিলেন সে দিন। তবে রাজনীতি নিয়েও যে কথা হয়েছিল, শোভনকে দলে ফেরানোর বিষয়ে যে পার্থ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন সে বৈঠকে, তা-ও বৈশাখী সে দিন অস্বীকার করেননি। তৃণমূল সূত্রের খবর, পার্থ-বৈশাখীর ওই বৈঠকেই ঘুঁটি সাজানো হয়ে গিয়েছিল। এ দিন মমতার হাত থেকে শোভন ও বৈশাখী ফোঁটা পেলেন ওই বৈঠকের ফলশ্রুতিতেই।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের থেকে মুক্তি চেয়ে তুমুল বিক্ষোভ অধিকৃত কাশ্মীরে, চলছে সেনা পীড়ন, বাইরে এল ভিডিয়ো
শোভন ঘনিষ্ঠরা অবশ্য দাবি করছেন, এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই, পুরোটাই সৌজন্যের আবহে ঘটেছে। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ককে কেন্দ্র করেই মমতার সঙ্গে তাঁর প্রিয় কাননের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল— এমন একটা তত্ত্ব রাজনৈতিক শিবিরে উঠে এসেছিল শোভনের ইস্তফার পরে। বৈশাখী নিজেও তা জানতেন। সেই কারণেই যাবতীয় ‘ভুল বোঝাবুঝি’র অবসান ঘটাতে বৈশাখী নিজে সক্রিয় হয়েছিলেন বলে প্রাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত দাবি করছে। ভাইফোঁটার দিনটাই ‘ভুল বোঝাবুঝি’ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল বলে বৈশাখী মনে করছিলেন। এমনও দাবি করছে শোভন শিবির।
এ দিন ফোঁটা দেওয়ার পরে ‘দিদি’ তাঁর প্রিয় কাননকে চারটে পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছেন বলে খবর। বৈশাখীকে দিয়েছেন দুটো শাড়ি। ‘দিদি’কেও কানন দিয়েছেন দুটো শাড়ি। আর বোনফোঁটা নিয়ে বৈশাখী এ দিন মমতাকে দিয়েছেন এক বাক্স চকোলেট। জানা গিয়েছে শোভন ঘনিষ্ঠদের সূত্রে। ফোঁটা পর্ব মেটার পরে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে মমতা দীর্ঘক্ষণ খুব ফুরফুরে মেজাজে গল্প-গুজব করেছেন বলেও জানা গিয়েছে। তৃণমূলে শোভনের দীর্ঘ যাত্রাপথ, দলের জন্য কাজ করা, নানা বিপদ-আপদ, সে সব সমলানোয় মমতার ভূমিকা— খোশগল্পে দেদার স্মৃতি রোমন্থন চলে। তৃণমূলের শাখা সংগঠনের হয়ে বৈশাখী যে সময়ে কাজ করেছিলেন, উঠে আসে সে সময়ের কথাও।
আরও পডু়ন: মহা-সঙ্ঘাত চরমে, বিজেপি ৫০-৫০ উড়িয়ে দিতেই যৌথ বৈঠক বাতিল করল শিবসেনা
যে সম্পর্ক পুরোপুরি ঠান্ডাঘরে চলে গিয়েছিল, তাতে আচমকা এত উষ্ণতা কি শুধু সৌজন্যের খাতিরে? এর মধ্যে রাজনীতির কোনও সমীকরণ লুকিয়ে নেই? অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণে উঠেছে এই প্রশ্ন। শোভন বা বৈশাখী, কেউই মুখ খোলেননি তা নিয়ে। কিন্তু বৈশাখীর ঘনিষ্ঠদের দাবি— সৌজন্য ছাড়া আর কিছুই নেই এর মধ্যে। ভাইফোঁটা উপলক্ষে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁরা সৌজন্য দেখিয়েছেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই বলেও শোভনের ঘনিষ্ঠরা দাবি করছেন। ভাইফোঁটা উপলক্ষে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকেও বৈশাখী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বলে তাঁরা জানাচ্ছেন।
গোটা বিষয়টি নিয়ে বিজেপির প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সতর্ক। দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘‘ভাইফোঁটায় কে কার বাড়ি গেলেন, তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই।’’ দিলীপ আরও বলেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি ভাইফোঁটায় তাঁকে ডাকতেন, তা হলে তিনিও যেতেন।