কাঠগড়ায় অবশ্য শুধু শাসক দলই নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা তরুণ জানাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে ইভিএম ভাঙচুরের অভিযোগে বিজেপি প্রার্থী সুজয় চন্দ্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। হরিণঘাটার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী সুরেশ সিকদার ইভিএম আছড়ে ভাঙেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে কংগ্রেসের বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র।
ছাপ্পা, বুথদখল, বোমা, গুলি— রাজ্য জুড়ে এমন বিক্ষিপ্ত অশান্তির অভিযোগের মধ্যেই শেষ হল মোট ১০৮টি পুরসভায় ভোটগ্রহণ পর্ব। দৃশ্যত বড় অশান্তি দেখা যায়নি বটে, তবে উত্তর থেকে দক্ষিণ, রাজ্যের সব এলাকা থেকেই অশান্তির খবর এসেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের উপরে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। বিজেপি, বাম এবং কংগ্রেস— সব বিরোধী পক্ষই এই ভোটকে একসুরে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের অবশ্য পাল্টা দাবি, রাজ্যে মোট ১১ হাজারেরও বেশি বুথে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে অশান্তির অভিযোগ এসেছে বড় জোর ১৫-২০টি বুথে। তার মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী এবং কোথাও কোথাও সংবাদমাধ্যমের ‘প্ররোচনা’ ছিল।
রাজ্য পুলিশ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন এক সুরেই জানিয়েছে, বড় কোনও গোলমাল ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট হয়েছে। কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট পড়েছে প্রায় ৭৭%। রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবীয় জানিয়েছেন, ভোটে গোলমাল পাকানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে ৫৩ জন। আর সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৮৭ জনকে।
পুলিশ কথিত ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোটে কেমন ভাবে ‘দাগ’ লেগেছে রবিবার? ধরা যাক জলপাইগুড়ি শহরের কথা। বরাবর সৌজন্যের শহর হিসাবেই পরিচিত জলপাইগুড়ি। সকাল থেকে মোটামুটি শান্ত ভোটপর্বের ছবিটা বদলে গিয়েছিল দুপুর থেকে। একটা সময়ে শহরের ৯টি ওয়ার্ডে বুথ দখল করে ছাপ্পার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ, উমাগতি স্কুল থেকে ভয় পেয়ে আশা-কর্মীদের কাঁদতে কাঁদতে বার হয়ে আসতে দেখা যায়। একই ভাবে জেলার আর এক শহর ময়নাগুড়িতে ১ নম্বর ওয়ার্ডের পেটকাটির ভাঙা থেলথেলা প্রাথমিক স্কুলে ছাপ্পার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ করতে গেলে মারামারিতে বিজেপি প্রার্থী প্রণতি চন্দ সরকারের মাথা ফাটে। মালদহের ইংরেজবাজার শহরে অক্রুরমণি করোনেশন ইনস্টিটিউটে বিজেপি কর্মী অনুপ চৌধুরীকে দুষ্কৃতীরা এমন মারধর করে যে, তাঁকে মালদহ মেডিক্যালে ভর্তি করাতে হয়। বুথ দখলের অভিযোগে সেখানে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা শহরে বুথ দখলের অভিযোগ তোলার পরে উল্টে কংগ্রেস প্রার্থীর এজেন্টকেই মারধর করা হয় বলে দাবি।
এই ‘দাগ’ শুধু উত্তরবঙ্গে নয়, দক্ষিণেও বহু জায়গায় লেগেছে নির্বাচনের গায়ে। হুগলির আরামবাগে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী সুশীল বাড়ুইকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। সেখানেই বেলায় প্রায় সব বুথ দখল করে তৃণমূল ছাপ্পা দিয়েছে বলে বিরোধীদের দাবি। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে বিরোধীরা বারবার ছাপ্পা ভোট, সন্ত্রাস, বিরোধীদের উপরে হামলার অভিযোগ তোলেন। দিনের শেষে এই সব কারণে সিপিএম ৭টি ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করে। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী প্রত্যাহার করে বিজেপিও। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বোমাবাজি ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। বহরমপুরে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস প্রার্থী কনিকা কুণ্ডুর স্বামীকে মারধর করে কান ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
ভোটের দিনে এমন নানা অভিযোগ সামনে রেখেই বালুরঘাটে এ দিন দুপুরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দাবি করেন, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা উচিত। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাসের সঙ্গে দেখা করে রাজ্য বিজেপির তরফে অগ্নিমিত্রা পাল, শিশির বাজোরিয়া, লোকনাথ চট্টোপাধ্যায়েরা দাবি করেন, এই ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন হোক। পরে সন্ধ্যায় রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গেও দেখা করেন তাঁরা। রাজ্যপালকে চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন, ‘আমরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তাই এই ভোটের নামে প্রহসন বাতিল করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায় নতুন করে ১০৮টি পুরসভায় ভোট করার জন্য আপনার হস্তক্ষেপ চাইছি’।
রাজ্যপাল ধনখড় অবশ্য তার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র নিয়ে আজ, সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে রাজভবনে দেখা করতে বলেছেন তিনি। পুরভোটের প্রেক্ষিতে রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকাকে ‘পক্ষপাতমূলক’ বলেও মন্তব্যে করেছেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্য, ‘‘এই রাজ্যপালের কাছে এটাই প্রত্যাশিত! উনি বরং ঝান্ডা নিয়ে বিজেপির বন্ধ সফল করতে রাস্তায় নেমে পডু়ন! সেটাই ওঁকে মানাবে ভাল।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত, সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ, রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য এবং সাংসদ অর্জুন সিংহের বক্তব্য, কমিশন আদালতে জানিয়েছিল, রাজ্য পুলিশ দিয়েই অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ ভোট পরিচালনা করতে তারা সক্ষম। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবে তারা তৃণমূলের শাখা সংগঠন হিসাবে কাজ করল এবং আদালতকে দেওয়া কথা রাখতে পারল না। এই প্রেক্ষিতে কমিশনকে ‘জঙ্গি সংগঠন’ বলে খোঁচা দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভবাবুকে গ্রেফতার করার দাবি তুলেছেন অর্জুন। আর দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশন মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’’
অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা দাবি করেছেন, ‘‘যে গোলমালের কথা বলা হচ্ছে, তা ক’টা জায়গায় হয়েছে? ১১ হাজার ২৮০টি বুথে ভোটগ্রহণ হয়েছে। তার মধ্যে গোটা ১৫ বুথে গোলমাল। আমরা দেখেছি, যেখানে বিরোধী নেতারা কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ঘুরেছেন, সেখানেই উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তাতে গোটা রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। বিজেপির দিলীপ ঘোষ, অর্জুন সিংহ, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীরাই তো কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ঘুরেঘুরে প্ররোচনা তৈরি করেছেন!’’
নির্বাচনকে ‘প্রহসনে পরিণত করা ও গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরার’ প্রতিবাদে আজ, সোমবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বামফ্রন্ট। জেলায় জেলায় মহকুমা শাসক তথা রিটানিং অফিসারের দফতরেও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে তারা। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যে ১০৮টি পুরসভার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বিভিন্ন পুর-এলাকায় নাগরিকদের নিজের ভোট নিজে দেওয়ার ক্ষেত্রে শাসক দল তৃণমূল নানা ধরনের সন্ত্রাসমূলক কৌশলে ভোটাধিকার হরণের বেপরোয়া চেষ্টা চালিয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের সহযোগিতায় তৃণমূল ভোটগ্রহণ-পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই যে ভাবে ভোটারদের বাধা দিয়েছে ও নাগরিকদের অধিকার হরণ করেছে, তা গণতন্ত্রের পক্ষে অশনি সঙ্কেত’।
কলকাতা এবং অন্য চার পুর-নিগমের নির্বাচনের পরে এ দিনের পুরভোটেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিই ‘কলঙ্কিত’ হল বলে অভিযোগ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। উত্তরপ্রদেশে শান্তিপূর্ণ বিধানসভা ভোটের কথা উল্লেখ করে অধীরবাবু বলেছেন, ‘‘অন্য কোনও রাজ্যে শোনা যায়নি নির্বাচনের দিন এ ভাবে দাঙ্গা বাহিনী মদ খেয়ে, কোমরে মেশিন নিয়ে মোটরবাইক নিয়ে পুলিশকে কুকুর বানিয়ে একের পর এক বুথ পরিকল্পিত ভাবে দখল করে!’’ তবে শাসক দল বেলা বারোটা পর্যন্ত মানুষকে ভোট দিতে ছাড় ছাড় দিয়েছিল এবং তার পরে তারা বেপরোয়া হয়ে বুথ দখল করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। প্রদেশ সভাপতির মন্তব্য, ‘‘মহিলাদেরও রক্তাক্ত করেছে দিদির দল! দিদিকে অনুরোধ করেছিলাম, স্থানীয় নির্বাচনকে উৎসবের রূপ দিতে। দিদি আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আবার সেই কথার খেলাপি করলেন তিনি!’’ যে ভাবে পুরভোট হয়েছে, তার প্রতিবাদে সরব হয়েছে এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন, পিডিএস-সহ বিভিন্ন বামপন্থী দলও।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে ‘প্রহসনের’ প্রতিবাদে এ দিনই বিক্ষোভ দেখায় কংগ্রেস। ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক অসিত মিত্র, সুমন পাল, প্রদীপ প্রসাদ, আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ প্রসাদেরা। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করে। কংগ্রেস আজও কালো ব্যাজ পরে কলকাতায় ভবানী ভবন ও নির্বাচন কমিশনে এবং জেলায় পুলিশ সুপারের দফতরের সামনে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। কল্যাণ চৌবে, সজল ঘোষদের নেতৃত্বে বিজেপির ‘লালবাজার অভিযান’ও এ দিন বৌবাজার মোড়ে আটকে দেয় পুলিশ।
অধীরের মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি জাল ভোট, গোলমালের অভিযোগ উঠেছে অন্যত্রও। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে ছাপ্পা ভোট, তমলুকে বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত চৌধুরীকে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। কাঁথিতে দুই সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। প্রভাত কুমার কলেজের সামনে বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর ভাই সৌমেন্দু অধিকারীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল কর্মীরা। অভিযোগ, কাঁথির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে একটি বুথে ছাপ্পা দিতে গিয়ে ধরা পড়ে জনতার প্রতিবাদে মোটরবাইক ফেলে পালায় দুষ্কৃতীরা। জলপাইগুড়ির মতো মেদিনীপুর শহরেও শেষ বেলায় একাধিক বুথ দখল করে ছাপ্পা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ইভিএম ভাঙচুরের অভিযোগ এসেছে বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুর-সোনারপুর, মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর, হাওড়ার উলুবেড়িয়া থেকেও। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর-মজিলপুরের ২ নম্বর বুথ দখল করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বুথটি থানা থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে। এমনই অভিযোগ এসেছে পাশের জেলার বনগাঁ শহর থেকেও।
ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে কিন্তু এ দিন তেমন গন্ডগোলের অভিযোগ ছিল না। শুধু স্থানীয় বিজেপি সাংসদ অর্জুনকে গাড়ি নিয়ে বার হতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিজেপি অভিযোগ করে, টিটাগড়, ব্যারাকপুর, গারুলিয়া থেকে নৈহাটি, হালিশহর, কাঁচরাপাড়ায় প্রভাব খাটিয়ে ভোট করেছে তৃণমূল। এর পাশাপাশি খড়্গপুর, জয়নগর থেকে বোমা ও গুলির অভিযোগ সামনে এসেছে। বোমাবাজির অভিযোগ এসেছে উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা থেকেও।
কাঠগড়ায় অবশ্য শুধু শাসক দলই নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা তরুণ জানাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে ইভিএম ভাঙচুরের অভিযোগে বিজেপি প্রার্থী সুজয় চন্দ্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। হরিণঘাটার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী সুরেশ সিকদার ইভিএম আছড়ে ভাঙেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। গাড়ি থেকে নেমে মোটরবাইক আরোহীদের উপরে চড়াও হওয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্তের বিরুদ্ধেও। যদিও সুকান্ত জানান, তিনি তৃণমূলের বাইক বাহিনীকে আটকাতে গিয়েছিলেন। তৃণমূল তাঁর বিরুদ্ধে গোলমাল বাঁধাতে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ এনেছে।