সকলে মিলে মাংস রান্নার প্রস্তুতি। —নিজস্ব চিত্র।
সব উৎসব যেন ভিড় করে মিশে গিয়েছে একটি উৎসবেই।
কেউ আবির উড়িয়ে দিয়েছেন আকাশে। কেউ নতুন জামা পরে বেরিয়েছেন। কারও বাড়ি থেকে আসছে পোলাও-মাংসর গন্ধ। কেউ উঠোন নিকোচ্ছেন। কোথাও পতাকা তোলার আয়োজন সম্পূর্ণ। কারও উঠোনে আতসবাজি শোকাচ্ছে রোদে।
শুক্রবার এ ভাবেই স্বাধীনতা পালিত হবে ছিটমহলগুলিতে। মশালডাঙা, কচুয়া, করলা, বাত্রীগছ, পোয়াতুর কুঠি থেকে শুরু করে ছাট কুচলিবাড়ি, বালাপুকুরি, মৃগীপুর সহ ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল। এখন অবশ্য সেগুলি আর ছিটমহল নয়, ভারতের গ্রামই বলা চলে। রাত ১২টার পরে বাড়িতে বাড়িতে উড়বে জাতীয় পতাকা। মশাল জ্বালানো হবে। চলবে আতসবাজিরও পালা। আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হবে আতসবাজির মাধ্যমে। ৬৮টি মোমবাতি জ্বালানো হবে বাড়িতে বাড়িতে। ভারতের স্বাধীনতার ৬৮ বছর পরে যে স্বাধীনতা পেলেন তাঁরা।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “আজ সবাই স্বাধীনতা উৎসবে মেতেছে। সবাই নিজের নিজের মতো করে আনন্দ করছে। ভাল খাওয়াদাওয়া তো বটেই। অনেকে নতুন পোশাকও কিনেছে। আমাদের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছে সকলে। এই স্বাধীনতার উৎসব চলতেই থাকবে।” কচুয়া ছিটমহলের বাসিন্দা আব্দুল বারিক, মনা বর্মনরা বলেন, “আমাদের গ্রামে আজ এমন একটি বাড়ি নেই যেখানে ভাল কিছু রান্না হয়নি। বাজার থেকে মাংস নিয়ে এসেছে সবাই। অনেকে মাছও এনেছে। তা রান্না হচ্ছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সবাই মিলে অনুষ্ঠান দেখতে যাব।” নতুন পোশাক পড়েছেন ওই ছিটমহলের বাসিন্দা তরুণ কবিরুদ্দিন শেখ। তিনি বলেন, “আজ স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই নতুন পোশাকে বেরোতে চাই।”
মধ্য মশালডাঙায় স্বাধীনতা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটি। অনুষ্ঠানের মঞ্চ বাঁধার কাজ চলছে। ওই মঞ্চেই চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একটি তথ্যচিত্র দেখানো হবে। ছিটমহলের মানুষ নিজেদের দুঃখ, দুর্দশা আর সেখান থেকে লড়াই করে বেঁচে থাকার কথা শোনাবেন। অনুষ্ঠানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজির হয়েছেন মানুষ। ছিটমহলের উপরেই তৈরি করা তথ্যচিত্র সহ নানা অনুষ্ঠান করছেন তাঁরা। সেখানে নানা জায়গা থেকে টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরাও হাজির হয়েছেন। তাঁদের জন্যও খাবারের আয়োজন করেছে বিনিময় সমন্বয় কমিটি। কমিটির নেতা বেল্লাল হোসেনের বাড়িতে বসেছে রান্নার আসর। বাসিন্দারা জানান, অনুষ্ঠানের জন্য কেউ ৫০০ টাকা, কেউ ১০০০ টাকা করে দিয়েছেন। ওই টাকাতেই মঞ্চ হয়েছে। বাজার হয়েছে। বেল্লাল হোসেন বলেন, “আজ তো আমরা স্বাধীনতা পেতে চলেছি। সবার বাড়িতে ভালমন্দ রান্না হয়েছে। অতিথিরা কেন বাদ যাবেন? তাঁদের জন্যও আলাদা করে রান্না হয়েছে। সবাই মিলে আনন্দ করব।”
ছিটমহলের বাসিন্দারা কৃষি কাজের উপরেই নির্ভরশীল। বেশিরভাগই পড়াশোনা শেখার সুযোগ পাননি। গরিব মানুষের বাসই বেশি। তবুও আজ আনন্দে খামতি নেই কারও। আমেতা বিবি, বিলকিস সরকার, নাসিমা সরকার সকলেই খুশি। আসেমা বলেন, “আজ সকাল সকাল রান্না করেছি। মাছ এনেছিল বাড়িতে। তার পর অনুষ্ঠানের আয়োজনের সহযোগিতায় নেমেছি। সবাই মিলে ভাল কিছু করতে চাই আজ।” তরুণ সাদ্দাম মিয়াঁ বলেন, “সারা রাত ধরে আনন্দ করব আমরা। চারদিক আলোকিত করতে চাই। মোমবাতি জ্বলবে। মশাল জ্বলবে। এতদিন পরে স্বাধীনতা পেলাম। আনন্দ আমাদের শেষ হবে না।”
আজ, শনিবার সকাল ৯ টায় ৫১ টি ছিটমহলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাতীয় পতাকা তোলা হবে। সে ব্যাপারেও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রশাসনিক আধিকারিকরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কোথায় পতাকা তোলা হবে সে জায়গা চিহ্নিত করেছেন। তা সাজানোর কাজ করছেন ছিটের বাসিন্দারাই।