সুবিচারের অপেক্ষায় কাটোয়া-কাণ্ডে অভিযোগকারিণী। বৃহস্পতিবার। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ শীতের একটা সন্ধে লহমায় পাল্টে দিয়েছিল সব কিছু।
আতঙ্কের একটা অদৃশ্য দেওয়াল হঠাৎই ঘিরে ফেলেছিল বাড়িটাকে, যে আতঙ্ক আজও পুরোপুরি যায়নি।
কাঁথাস্টিচ আর গ্রামের একটি স্কুলে রান্নার কাজ করে নাবালিকা দুই মেয়েকে নিয়ে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন যে স্বামীহারা মহিলা, তিনি প্রায় ঘরবন্দি হয়ে গিয়েছেন। আজ, শুক্রবার তিনি বিচারের অপেক্ষায়।
ট্রেনে ডাকাতির সময়ে ১১ বছরের যে মেয়েটির মাথায় বন্দুক ধরে তার মাকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, পাশের ঝোপে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল দুষ্কৃতীরা, এ বার সে মাধ্যমিক দেবে। সে-ও আজ বিচারের অপেক্ষায়।
অপেক্ষায় তার বছর দুয়েকের বড় দিদিও। ওই সন্ধ্যায় সে মা-বোনের সঙ্গে ছিল না, কিন্তু অভিশাপের ভার তাকেও বয়ে বেড়াতে হয়েছে এত দিন। অপেক্ষায় সেই সব আত্মীয়-পরিজন, পাড়াপড়শি যাঁরা সবচেয়ে দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন, এখনও রয়েছেন পাশে।
সাড়ে তিন বছর আগে বীরভূমের আমোদপুর থেকে ছোট রেল (এখন ব্রডগেজ হচ্ছে) আসত বর্ধমানের কাটোয়ায়। ২০১২-এর সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মেয়েকে নিয়ে কীর্ণাহার থেকে ওই ট্রেনেই উঠেছিলেন মহিলা, ফিরবেন কেতুগ্রামের বাড়িতে। পথে অম্বলগ্রাম স্টেশনের আগে ট্রেন দাঁড় করিয়ে ডাকাতি শুরু হয়। আর তখনই ঘটে ওই ঘটনা।
প্রধান অভিযুক্ত রেজাউল করিম-সহ সাত জন গ্রেফতার হয়েছিল। পরে কাটোয়া সংশোধনাগারে টি আই প্যারেডের সময়ে ও আদালতে তিন অভিযুক্তকে শনাক্ত করেছেন মা ও মেয়ে। আজ, শুক্রবার মামলার রায় দেওয়ার কথা কাটোয়া ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের বিচারক কাজি আবুল হাসেমের। সাজা এ দিনই ঘোষণা হবে কি না, তা অবশ্য নিশ্চিত নয়।
বৃহস্পতিবার পড়ন্ত বিকেলে বাড়ির ভিতর বসে অভিযোগকারিণী বলছিলেন, “ওই সন্ধ্যা থেকে জীবনটা পাল্টে গিয়েছে। আগে আমার কত সাহস ছিল, এখন শুধু আতঙ্ক।” সেই থেকে এখনও তাঁদের বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা রয়েছে। তাতে কী? সে দিনের প্রত্যক্ষদর্শী নাবালিকা মেয়েটি বলে, “এখনও ঘুমের মধ্যে ওই সন্ধেটা দেখতে পাই। আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায়।”
গত সাড়ে তিন বছরে মাত্র দু’বার গ্রামের বাইরে গিয়েছেন মহিলা। তাঁর কথায়, “তখনও আমার সঙ্গে মহিলা পুলিশ ছিল। আসলে আমরা এতটাই ভীত যে, সূর্য ডুবে গেলে আর বাড়ির বাইরে পা রাখি না। মেয়েরা স্কুলে গেলে চিন্তায় থাকি। বলা তো যায় না, কখন কী হয়!” বিচার চলার সময়েও ফোনে তাঁদের হুমকি দেওয়া হত, অভিযুক্তদের শাগরেদরা তাঁদের এক পরিচিতকে পাকড়ে ভয় দেখিয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
শুধু ভয় নয়, আছে অস্বস্তিও।
ঘটনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পরিবারটির পাশে রয়েছে। তবু অস্বস্তি যায় না। অভিযোগকারিণীর কথায়, “ওঁদের মধ্যেও কেউ যখন মেয়েদের সামনে আমাকে দেখিয়ে কথা বলেন, লজ্জা করে। মুখ তুলে তাকাতে পারি না।” পাশ থেকে ছোট মেয়ে যোগ করে, “আমাকেও যখন কেউ দেখিয়ে বলে, ‘শয়তানেরা ওর মায়ের উপরে অত্যাচার করেছিল’, শুনতে খারাপ লাগে। সচরাচর রাস্তায় বেরোই না। জানলায় দাঁড়িয়ে অচেনা লোক দেখলেও ভয়ে বন্ধ করে দিই।”
এই ভাবে বাড়িতে গুটিয়ে যাওয়ায় আর্থিক সঙ্কটও স্বাভাবিক ভাবে ঘিরে ধরেছে। মহিলা বলেন, “আগে কাঁথা স্টিচের কাজ করতাম। এখন সব বন্ধ। মুড়ি ভেজে আর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চেয়ে-চিন্তে কোনও রকমে সংসার চালাচ্ছি। মেয়েদের স্কুলের বই পর্যন্ত কিনে দিতে পারিনি।” তাঁর একটাই আশা, যদি দোষীদের সাজা হয়, এই মেঘ হয়তো কেটে যাবে।
যদি সাজা না হয়?
শুনেই আঁতকে ওঠেন বিধবা— “আইন যদি ওদের সাজা না দেয়, যদি ছাড়া পেয়ে যায় ওরা, ওদের আক্রোশ থেকে ছাড় পাব?’’ একটু থামেন, ফের বলেন, ‘‘আর... সুবিচার যদি না হয়, এখন যারা পাশে আছে, তারাই হয়তো বিদ্রুপ করবে। মরণ ছাড়া আর কোনও গতি থাকবে আমার?”
ক’দিন পরেই তো পুজো আসছে। টের পাচ্ছেন?
“সাড়ে তিন বছরে পুজোর ক’দিন বাড়ির বাইরে পা রাখিনি। দোষীরা সাজা পেলে এ বার মণ্ডপের সামনে গিয়ে এক বার দাঁড়াব।”
বলেই মুখ নামিয়ে নেন, বোধহয় এতটা ভাবতেও ভয় পান আজকাল।