অর্জুন সিংহ। —ফাইল চিত্র।
অভিযুক্তকে পাকড়াও করতে গিয়ে আধা সেনার হাতে বাধা পেল পুলিশ। এক দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী (সিআইএসএফ)। আর এ রাজ্যের পুলিশ অন্য দিকে। সব মিলিয়ে দুই সরকারি বাহিনীর বেনজির দড়িটানাটানির সাক্ষী ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ভাটপাড়া। কাজে বাধা পেয়ে সিআইএসএফ জওয়ানদের বিরুদ্ধে মামলাও করল এ রাজ্যের পুলিশ।
ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট সূত্রে খবর, ভাটপাড়া-নৈহাটি সমবায় ব্যাঙ্কের কয়েক কোটি টাকা তছরুপ নিয়ে একটি অভিযোগের তদন্ত করছে কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ। তছরুপের ঘটনায় এফআইআরে অভিযুক্ত সঞ্জিৎ ওরফে পাপ্পু সিংহ। তিনি ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহের ভাইপো। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের দাবি, তদন্তে নেমে ফৌজদারি আচরণ বিধি (সিআরপিসি)-র ৪১ নম্বর ধারায় পাপ্পুকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল তদন্তকারীর কাছে হাজিরা দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি হাজির হননি।
ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের শীর্ষ আধিকারিকদের অভিযোগ, শুক্রবার মামলার তদন্তকারী আধিকারিক কৌশিক ঘোষ খবর পান যে, অভিযুক্ত পাপ্পু মজদুর ভবনে ‘লুকিয়ে’ আছেন। মজদুর ভবন হল ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহ এবং তাঁর বিধায়ক পুত্র পবন সিংহের বাসভবন এবং দলীয় কার্যালয়। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তা আজ বলেন, ‘‘এর আগেও নোটিস দিতে গিয়ে সমস্যা হয়েছিল। তাই আমরা আগেভাগে সতর্ক ছিলাম।” পুলিশ তাই মজদুর ভবনে যাওয়ার সময়, অর্জুন সিংহের উদ্দেশে একটি চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে পাপ্পুর বিরুদ্ধে হওয়া মামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সাংসদকে মজদুর ভবন তল্লাশির কাজে পুলিশের তরফে সহায়তা চাওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘‘আমরা খবর পেয়েছি মজদুর ভবনে অভিযুক্ত লুকিয়ে রয়েছে। আপনি যে হেতু ওই বাড়ির মালিক, তাই আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে বাড়ি তল্লাশি করার সময় পুলিশকে সহায়তা করতে।” ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তার কথায়,‘‘আমরা সাংসদ এবং বিধায়কের মর্যাদার কথা ভেবেই ওই চিঠি দিয়েছিলাম।”
আরও পড়ুন: ‘কোভিডের থেকে বেশি স্পিড আমাদের’, আশ্বাস মুখ্যসচিবের
পুলিশের অভিযোগ, বাস্তবে অবশ্য কোনও সহায়তা পায়নি পুলিশ। পাল্টা ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় তদন্তকারীদের মজদুর ভবনে পৌঁছনো মাত্র। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘মজদুর ভবনে ঢোকার মুখেই আমাদের অফিসারদের বাধা দেন সাংসদ এবং বিধায়কের নিরাপত্তায় মোতায়েন সিআইএসএফ জওয়ানরা। তাঁরা সার্চ ওয়ারেন্ট দেখতে চান।” পুলিশের দাবি, এফআইআর-এ অভিযুক্ত কাউকে গ্রেফতার করার জন্য ফৌজদারি আচরণ বিধি (সিআরপিসি)-র ৩৭ এবং ৪৭ নম্বর ধারায় পুলিশের অধিকার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী পুলিশ যে কোনও বাড়িতে ঢুকতে পারে অপরাধী বা অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে।
অর্জুন সিংহকে মজদুর ভবনে তল্লাশিতে সহায়তা করার জন্য দেওয়া
চিঠিতে সিআইএসএফ জওয়ানদের সই করা সেই বয়ান।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সিআইএসএফ জওয়ানরা পুলিশকে ব্যাপক বাধা দেন। ফলে মজদুর ভবন তল্লাশি না করেই শুক্রবার ফিরে আসতে হয় পুলিশকে। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা গোটা ঘটনা বেনজির হিসাবে বর্ননা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমত অভিযুক্ত নিজে সিআইএসএফের নিরাপত্তা পান না। দ্বিতীয়ত, সিআইএসএফের কাজ এখানে অর্জুন সিংহ বা পবনকে নিরাপত্তা দেওয়া। তাঁদের কোনও অধিকার নেই কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে কাজে বাধা দেওয়ার। সিআইএসএফ যা করেছে তা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ।” ওই পুলিশ কর্তা গোটা ঘটনাকে কয়েক বছর আগে বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় ঢুকে সেনাকর্মীদের জোর করে পুলিশি হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সিআইএসফের জওয়ানরা যা করেছেন তা পুরোটাই বেআইনি।’’
আরও পড়ুন: সংস্কৃত পড়তে পড়তে উধাও... প্রজ্ঞা থেকে নব্য জেএমবি-নেত্রী আয়েশা!
সামনাসামনি আধাসেনার জওয়ানদের মোকাবিলা না করে এ বার আইনি পথে এগনোর পন্থা নিচ্ছে পুলিশ। কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরা আদালতে গোটা বিষয়টা জানাচ্ছি এবং আদালতের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করব। যাতে ভবিষ্যতে সিআইএসএফ বা সাংসদ-বিধায়করা তদন্তে হস্তক্ষেপ না করতে পারেন।’’ সেই সঙ্গে প্রমাণ হিসাবে আদালতে অর্জুন সিংহকে মজদুর ভবনে তল্লাশিতে সহায়তা করার জন্য দেওয়া চিঠিতে সিআইএসএফ জওয়ানদের সই করা বয়ান পেশ করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। ওই চিঠিতে সিআইএসএফের স্পেশ্যাল সিকিউরিটি ইউনিটের এক কনস্টেবল সই করেছেন এবং লিখেছেন, ‘‘সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া মজদুর ভবনে পুলিশকে তল্লাশি করতে অনুমতি তাঁরা দিতে পারবেন না।”
ভাটপাড়া থানা ইতিমধ্যেই অর্জুন পুত্র এবং সিআইএসএফ জওয়ানদের বিরুদ্ধে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করে মামলা শুরু করেছে। সেটাও বেনজির। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর জোন) অজয় ঠাকুর বলেন, ‘‘সিআইএসএফ আইনবিরুদ্ধ কাজ করেছে। আমরা বিধায়ক পবন এবং চার জন সিআইএসএফ নিরাপত্তা কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি।”
যদিও গোটা ঘটনা নিয়ে সিআইএসএফের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কলকাতায় সিআইএসএফের এক আধিকারিককে ফোন করলে তিনি জানান, ‘‘নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা নয়ডা-র বিশেষ ইউনিট থেকে এসেছেন। তাঁদের বিষয়ে আমরা কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”
তবে তিনি জানান, ‘‘সিআইএসএফের কাজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দেওয়া। সেখানে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া উচিত নয়।” তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘‘জওয়ানদের সংশ্লিষ্ট ইউনিট থেকে নির্দিষ্ট নির্দেশ না থাকলে সাধারণত জওয়ানরা যাঁকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন তাঁর নির্দেশই মেনে চলেন।”
আর সেখানেই প্রমাদ গুণছে পুলিশ। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বন্দরের বিজেপি নেতা রাকেশ সিংহের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘সিআইএসএফ নিরাপত্তা পাচ্ছেন এমন কয়েক জন রয়েছেন যাঁরা বিভিন্ন মামলার এফআইআর-এ অভিযুক্ত। তাদের জেরা বা গ্রেফতার করতে গেলেও একই ধরনের সমস্যা হবে।”