আগ্নেয়গিরির শিখরে যেন পিকনিক চলছে! অথচ হুঁশ নেই কারও!
পশ্চিমবঙ্গ বসে রয়েছে টাইম বোমার উপরে! প্রতিদিনই একটু একটু করে ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে বিস্ফোরণের দিকে। সতর্ক-বাণী অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধনের।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির যে মূল্যায়ন করেছেন, তার সঙ্গে সহমত অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদেরা। তাঁরাও এক বাক্যে মানছেন, অর্থনীতির একেবারে গোড়ার কথা বলেছে প্রণববাবু। কর্মসংস্থান না-হলে অপরাধ-প্রবণতা বাড়বেই। এবং বাড়বে শাসক দলের ছাতার নীচেই আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতাও।
কিন্তু ঘটনা হল, এই অবস্থা পরিবর্তনের কোনও দিশা মিলছে না! রাজ্য সরকারের তরফে অবশ্যই দাবি করা হচ্ছে, শিল্পায়নের জন্য তারা সদাসচেষ্ট। তৃণমূল জমানার গত তিন বছরে বেশ কয়েক লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে সব ধরনের শিল্পে। আরও দাবি, একশো দিনের কাজের পরিধিও বাড়ানো হয়েছে। তবে দাবির সঙ্গে বাস্তব মিলছে না। প্রায় প্রতিদিনই সিন্ডিকেট ঘিরে সংঘর্ষ বা তোলাবাজি নিয়ে গোলমালেই তা বোঝা যাচ্ছে। প্রণববাবুও সেই কথাই বলেছেন।
কলকাতার আইআইএমে বক্তৃতা করতে এসে সোমবার প্রণববাবু বলেন, “তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজের ব্যবস্থা করাই অন্যতম গুরুতর সমস্যা। ইতিমধ্যেই চার পাশের অবস্থা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন।... বেশ বড় সংখ্যায় তরুণেরা অপরাধমূলক কাজের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রত্যেক দিন খবরের কাগজ বা টিভি খুললেই তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে!” ঘটনাচক্রে, প্রণববাবু যে দিন এ কথা বলেছেন, সে দিনই ধর্মতলায় তৃণমূলের শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে শিল্পের জন্য কোনও নির্দিষ্ট আশ্বাস দিতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের লোকজন যাতে তোলাবাজি না করে তার জন্য রুটিনমাফিক কিছু হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যা আসলে রাজ্যের বর্তমান সমস্যা ঘুরপথে মেনে নেওয়া বলেই শিল্প মহল মনে করে।
কর্মসংস্থান না-বাড়লে অপরাধ যে বাড়বে এই তত্ত্বগত অবস্থান প্রণববাবুর মতের সঙ্গে রাজ্যের শাসক দল পুরোপুরি একমত। কিন্তু এ রাজ্যে কর্মসংস্থান হচ্ছে না এবং তার ফলে অপরাধ বাড়ছে, সে কথা মানতে তারা নারাজ। অর্থনীতিবিদ এবং রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের ভাইস চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকারের কথায়, “প্রণববাবু যা বলেছেন, সেটা সব জায়গায় সব সময় সত্য।” কিন্তু এই অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য শিল্পের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ রাজ্যের তরফে হচ্ছে কি? অভিরূপবাবুর বক্তব্য, “বড় শিল্পে হয়তো বলার মতো কিছু এখনও হয়নি। কিন্তু নিগমের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে বলতে পারি, ছোট ও মাঝারি শিল্পে অবশ্যই উদ্যোগ হয়েছে। তবে তার সুফল বুঝতে একটু অপেক্ষা করতে হবে!”
শাসক দলের মহাসচিব তথা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, “বৃহৎ শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সব ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে। একশো দিনের কাজ আরও প্রসারিত হয়েছে। এর বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রেও অনেক নতুন নতুন কাজের জায়গা তৈরি হয়েছে।” রাস্তাঘাট, সেতু-সহ পরিকাঠামো তৈরি এবং তার পাশাপাশি নির্মাণ শিল্পে অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে বলে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রীর দাবি।
কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাস্তা-সহ পরিকাঠামো তৈরির কাজে নিযুক্ত ঠিকাদার হোন বা নির্মাণ শিল্পে ফ্ল্যাট-বাড়ি-আবাসন তৈরির কাজে নিযুক্তেরা সকলেই টের পাচ্ছেন সিন্ডিকেটের রমরমা! তোলাবাজির দাপট। রাজারহাট, নিউ টাউন, বেলেঘাটা, দমদম, সোদপুর সর্বত্রই সিন্ডিকেটের দখল ঘিরে শাসক দলেরই নানা গোষ্ঠীর লড়াইয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু নেই-রাজ্য এবং নৈরাজ্য, এই ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র!
কী বলছে সরকারি পরিসংখ্যান? সরকারের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে: ২০১১ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ২৯৬টি শিল্প-প্রস্তাব এসেছে। লগ্নি হবে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান ১ লক্ষ ৫৫ হাজারের বেশি। মজার ব্যাপার হল, এই সংস্থাগুলির মধ্যে শালবনিতে জিন্দল গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার নামও রয়েছে। যে প্রকল্পটি এখনও শুরু না হওয়ায় ক’দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী তাদের জমি নিয়ে নেওয়ার হুমকি দিয়ে এসেছেন! তা ছাড়া, সরকারি এক সূত্র জানাচ্ছে, তালিকার অনেকগুলি প্রকল্পই বাম আমলের।
যে জমি ব্যাঙ্ক নিয়ে গর্ব করে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী, তার থেকে এখনও কোনও শিল্পপতিই জমি নেননি। কারণ, জমি ব্যাঙ্কে একলপ্তে বেশি জমির সংস্থান নেই। সরকারের এক সূত্রের বক্তব্য, এই আমলে যে ক’টি সংস্থাকে জমি দেওয়া হয়েছে, তার সবটাই বাম আমলে তৈরি শিল্প-পার্কের অধিগৃহীত জমি। যদিও রাজ্যের ২৩টি শিল্প-পার্ক মিলিয়ে এখনও প্রায় ৩০০০ একর জমি খালি পড়ে। বিজ্ঞাপন দিয়েও খরিদ্দার নেই!
সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে: শেষ আর্থিক বছরে রাজ্যের ৩৮৬টি সংস্থা রুগণ হয়ে বিআইএফআর-এ গিয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। কর্মহীনতার নিরিখে পশ্চিবঙ্গ কোথায় দাঁড়িয়ে, ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের রিপোর্টে তার আভাস আছে। দেখা যাচ্ছে, শহরাঞ্চলে সংগঠিত শিল্প ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজারে ১৩৯ জন কর্মহীন। তার চেয়েও খারাপ অবস্থা যে চারটি রাজ্যের (ত্রিপুরা, সিকিম, কেরল, অরুণাচল), তারা কেউই ‘শিল্প-রাজ্য’ বলে পরিচিত নয়। গ্রাম-শহর মিলিয়ে যে ছবি, সেখানেও এ রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে গোয়া, ত্রিপুরা, সিকিম, কেরল ও বিহার।
শিল্প আর কর্মসংস্থানের এই করুণ ছবির মধ্যেই জাঁকিয়ে বসেছে তোলাবাজি ও সিন্ডিকেট-রাজ। বাড়ছে দুষ্কৃতী-দাপট। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা। শাসক দলের ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেট রাজের দাপট এতটাই যে তাদের ঠিক করে দেওয়া দামেই ইট, বালি, সিমেন্ট কিনতে বাধ্য থাকেন বাড়ি নির্মাতা। তার পরেও জিনিসের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার থাকে না। সিন্ডিকেট-রাজের সঙ্গে বেকারত্বের আর এক উপসর্গ তোলাবাজিও যে বাড়ছে, সাম্প্রতিক জামুড়িয়া-কাণ্ডই তার উদাহরণ। প্রণববাবুর সুরেই এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায় বলছেন, “শিল্প না হলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ে। তারা কাজের জন্য রাজনৈতিক ছাতার তলায় যেতে চায়। যে হেতু সরকারের হাতেই কাজের চাবিকাঠি, তাই বেকারদের কাছে শাসক দল হল চুম্বক।” তাঁর আরও বক্তব্য, “শিল্পায়ন যত কমবে, কাজের সুযোগ কমবে, সরকারের ক্ষমতা তত বাড়বে। রাজ্যে নৈরাজ্যও বাড়বে।” প্রণববাবুর বক্তৃতার সময় উপস্থিত আর এক অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্ত বলছেন, “অবস্থার উন্নতির জন্য অনেক রকম দাবি রোজ শুনছি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোনও উন্নতি তো দেখছি না!”
বিরোধী রাজনীতিকরাও দাঁড়াচ্ছেন প্রণববাবুর পাশে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর কথায়, “বামফ্রন্ট আমলে শিল্পায়নের চেষ্টা হয়েছিল। তৃণমূল তাতে বাধা দিয়েছে শুধু নয়, এখন তাদের আমলে চালু কারখানাও একের পর এক বন্ধ হচ্ছে!” বিনিয়োগ চলে যাওয়া এবং জঙ্গি আন্দোলনের জেরে কর্মহীনতা ও অনিশ্চয়তা থেকেই এ রাজ্যে ছয়ের দশকে নকশাল আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছিল, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। তাঁর বক্তব্য, “সাম্প্রতিক কালে শিল্পে পিছনে হাঁটা শুরু হল সিঙ্গুর থেকে। রাজ্যের শিল্পায়নের স্বার্থে বিধানসভায় প্রস্তাব দিয়েছি, সিঙ্গুর নিয়ে আদালতের বাইরে সমঝোতা হোক। আর সরকার পরিকাঠামো তৈরিতে আন্তরিক ভাবে নজর দিক। কিন্তু সরকারের হেলদোল দেখছি না!”
অতএব, কা কস্য পরিবেদনা!