বাঁকুড়া আদালতে উদয়ন দাস। মঙ্গলবার। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
‘উদয়ন খুন হয়েছে’!
মেয়ে আকাঙ্ক্ষার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে এমন ‘মেসেজ’ পেয়ে চমকে উঠেছিল বাঁকুড়ার শর্মা পরিবার।
সময়টা অক্টোবর মাসের শেষ দিক। অক্টোবর মাসের গোড়াতেই (৫ অক্টোবর) বাঁকুড়া শহরের রবীন্দ্র সরণিতে আকাঙ্ক্ষার বাড়িতে রাত কাটিয়ে গিয়েছে উদয়ন। পরিচয় দিয়েছে ইউনিসেফ-এ আকাঙ্ক্ষার সহকর্মী হিসেবে। তরুণীর বাবা শিবেন্দ্র শর্মা, মা শশীবালাকে দিয়ে গিয়েছে আশ্বাস—‘‘যবে চান, দিল্লিতে আসুন। আমি এখন দিল্লিতে রয়েছি। ওখানে আমি আপনাদের আমেরিকার ভিসার কাগজপত্র দিয়ে দেব। আপনারা দিল্লি থেকেই যেতে পারবেন সোনির (আকাঙ্ক্ষার ডাকনাম) কাছে।’’
শর্মা পরিবার জানাচ্ছে সে সময়, আকাঙ্ক্ষার ভাই আয়ুষের পাসপোর্ট ছিল না। তাই অক্টোবরের মাঝামাঝি দিল্লি রওনা দেন শিবেন্দ্র-শশীবালা। তাঁদের দাবি, উদয়ন তাঁদের বলেছিল, দিল্লি পৌঁছে তাকে একটা ফোন করতে। বাকি দায়িত্ব তার। কিন্তু নয়াদিল্লি স্টেশন থেকে বহু বার ফোন করেও তাঁরা উদয়নের হদিস পাননি। কারণ, ফোন কেউ ধরেনি।
শর্মা দম্পতি যে দিন দিল্লি পৌঁছন, তার পরদিনই বাঁকুড়ায় ফেরার ট্রেন ধরেন। তাঁরা ধন্দে ছিলেন কেন এমন করল উদয়ন? শিবেন্দ্রবাবুর কথায়, ‘‘মেয়েকে হোয়্যাটসঅ্যাপ করে পুরো ঘটনাটি জানাই।’’ দিনকয়েকের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার নম্বর থেকে আসে জবাবি হোয়াটসঅ্যাপ—‘উদয়ন খুন হয়েছে’।
মঙ্গলবার আয়ুষ দাবি করেন, ‘‘দিদির নম্বর থেকে আসা ওই মেসেজটায় বলা ছিল, ‘উদয়ন খুন হয়েছে আমেরিকায়। ওর এক সহকর্মী ওকে খুন করেছে। আমি ওর মা-র (ইন্দ্রাণী দাস) কাছে যাচ্ছি। উদয়নের ফোন আমার কাছেই রয়েছে। মেসেজ পেয়ে আমরা তো অবাক!’’ এর পরে উদয়নের নম্বর থেকে আকাঙ্ক্ষার নাম করে তাঁদের কাছে বেশ কয়েকবার ‘মেসেজ’ এসেছে। ফলে, শর্মা পরিবারের প্রাথমিক ধারণা ছিল, আকাঙ্ক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনির্য়ায় নিজের কর্মস্থলে ঠিকঠাকই আছেন।
কিন্তু বহু দিন মেয়ের মুখ দেখতে না পেয়ে বা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে না পেরে চিন্তা বাড়ছিল শিবেন্দ্রবাবুদের। শশীবালাদেবী বলেন, ‘‘সোনির নম্বরে মেসেজ করেছিলাম, সেলফি তুলে পাঠাতে বা এক বার ফোনে কথা বলতে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তার কোনওটাই হয়নি। শুধু মেসেজ আসত—‘আমেরিকার সিম-কার্ড পেলেই ফোন করব’।’’
‘দিদি’ ঠিক আছে কি না বুঝতে কৌশল করেন বছর চব্বিশের আয়ুষ। ‘মেসেজ’ পাঠান, ‘বাবার খুব শরীর খারাপ। তুই টাকা পাঠা’। নভেম্বরের শেষ দিকে আকাঙ্ক্ষার নম্বর থেকে জবাবে আসে, তিনি বাঁকুড়ায় আসছেন। তার দিন দু’য়েক বাদে ‘মেসেজ’—‘আমি দিল্লি থেকে কলকাতার উড়ান ধরছি’। ওই দিনই ফের ‘মেসেজ’—‘দুর্গাপুরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছি। বাড়ি যাচ্ছি না’।
কেন তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিলেন বারবার জানতে চেয়েও জবাব না পেয়ে উগ্বিগ্ন হয়ে আকাঙ্ক্ষার খোঁজ শুরু করেন শর্মারা। ৫ ডিসেম্বরে বাঁকুড়া সদর থানায় নিখোঁজ-ডায়েরি করেন তাঁরা। পুলিশ তাঁদের জানায়, ‘টাওয়ার লোকেশন’ অনুযায়ী, আকাঙ্ক্ষার মোবাইল রয়েছে ভোপালের সাকেতনগরে।
শিবেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘জানতাম, উদয়নের বাড়ি সাকেতনগরে। পুলিশ সেখানেই মেয়ের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন পাওয়ায় চমকে যাই। সাকেতনগরে গিয়ে শুনি, উদয়ন বেঁচে আছে। খুন হওয়ার খবরটা নাটক!’’
তবে এ ঘটনায় অবাক হচ্ছেন না তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, ‘ফেসবুক’-এ উদয়নের বানানো নকল ‘প্রোফাইল’-এর সংখ্যা প্রায় ৪০। ফলে, এমন এক জন যে অন্যের নম্বর থেকে ‘হোয়্যাটসঅ্যাপ’ করে নিজের মৃত্যুসংবাদ রটাবে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না তাঁরা। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা বলেন, ‘‘উদয়ন যে সব ফেসবুক প্রোফাইল বানিয়েছিল, সেগুলো ব্যবহার করে ও কী-কী করেছে, দেখছি আমরা।’’
পুলিশ জেনেছে, ‘ফেসবুক’-এ উদয়ন নিজে যে ‘প্রোফাইল’টি তুলনায় বেশি ব্যবহার করত সেটি ‘উদয়ন ফান রিখটহোফান মেহরা’র নামে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান বিমান বাহিনীতে নামজাদা বৈমানিক ছিলেন মানফ্রেড ফান রিখটহোফান ওরফে ‘রেড ব্যারন’। উদয়নের ছদ্মনামে সেই ‘রেড ব্যারন’-এর নামের ছায়া দেখছেন তদন্তকারীরা। তবে দাস পদবির বদলে মেহরা কেন—তার কোনও জবাব এখনও নেই তদন্তকারীদের কাছে।
ওই ‘প্রোফাইল’ অনুযায়ী, উদয়ন মার্কিন বিদেশ দফতরে ফরেন সার্ভিস অফিসার হিসেবে কর্মরত। কাজ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি-ও করছে।
‘প্রোফাইল’-এর ‘ওয়াল’-এ ২০১৩-র একটি ‘পোস্ট’-এ ছবি রয়েছে উদয়নের। সঙ্গে তার গাড়ি বদলের খবর। মার্সিডিজ এএমজি-র বদলে ল্যাম্বরগিনি আভেন্তাদোর এলপি ৭০০-৪।
চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি তাতে ‘আমার বরই সেরা’ বলে মন্তব্য রয়েছে ‘আকাঙ্ক্ষা উদয়ন মেহেরা’র (যে মহিলার প্রোফাইলের ছবিটি বাঁকুড়ার আকাঙ্ক্ষার বলে দাবি শর্মা পরিবারের)। একই পোস্টে ‘গতিসীমার নীচে গাড়ি চালিও এবং সিটবেল্ট পোরো’ বলে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে মন্তব্য রয়েছে উদয়নের বাবা বীরেন্দ্র দাসের নামে বানানো ‘প্রোফাইল’ থেকে।
‘ফেসবুক’-এ ‘আকাঙ্ক্ষা উদয়ন মেহেরা’ ওয়াশিংটনের বাসিন্দা বলে লেখা রয়েছে। নিজের ‘ওয়াল’-এ তাঁর শেষ ‘পোস্ট’ গত ২৫ ডিসেম্বরে করা। সে দিন তিনি ‘স্বামী’ উদয়নকে (নিবাস ক্যালিফোর্নিয়া) ‘মেরি ক্রিসমাস’ জানিয়েছেন। এ দিকে, আয়ুষ জানাচ্ছেন, ২৩ জুন আকাঙ্ক্ষা বাঁকুড়া ছাড়েন। তার মাসখানেকের মধ্যেই তাঁর ‘ফেসবুক প্রোফাইল’ থেকে ‘ব্লক’ করা হয় আয়ুষকে। দিদি কেন এমন করল তা জানতে চেয়েছিলেন তিনি। হোয়্যাটসঅ্যাপে জবাব পান, ‘ফেসবুক প্রোফাইল’ বন্ধ করছেন আকাঙ্ক্ষা। আয়ুষের আক্ষেপ, ‘‘দিদি বা উদয়নের অন্য কোনও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে কি না, খুঁজে দেখিনি। দেখলে হয়তো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ত!’’
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘উদয়ন আমাদের বলেছে, ও ওর বাবা-মা-কে খুন করে ২০১০-এ। আকাঙ্ক্ষাকে খুন করা হয় গত জুলাই বা অগস্টে। নিহতদের জীবিত বলে প্রমাণ করতেই ও ফেসবুকে নকল প্রোফাইলগুলো তৈরি করে।’’
কিন্তু আকাঙ্ক্ষাকে খুন করার কারণ কী?
পুলিশ সূত্রের খবর পাওয়া গিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া, ভিসার খরচ বাবদ মেয়েকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন শিবেন্দ্রবাবু। আদতে শর্মারা পটনার বাসিন্দা। সেখানে মেয়ের সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মে মাস নাগাদ ওই টাকা জমা দেন তিনি। জুনে বাড়ি ছাড়ার সময়ে ওই অ্যাকাউন্টের এটিএম কার্ডটি নিয়ে যান আকাঙ্ক্ষা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর কার্ড ব্যবহার করে সেখান থেকে ৮০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। পরে আরও কয়েক দফায় তুলে নেওয়া হয় পুরো টাকাটাই।
টাকার জন্যই কি খুন করা হয়েছে আকাঙ্ক্ষাকে? শিবেন্দ্রবাবু-শশীবালাদেবীরা বলেন, ‘‘বলা খুব কঠিন। উদয়নের বাবা-মা-র খুনের ঘটনা জেনে ফেলাটাও সোনির কাল হয়ে থাকতে পারে!’’