ধর্মতলার মঞ্চে তখন ভাষণ দিচ্ছেন মমতা। ছবি: পিটিআই।
মঞ্চে পৌঁছনো দূরের কথা, তখনও তিনি বাড়ি থেকেই বেরোননি। বিভিন্ন রাস্তা ধরে শুধু স্রোতের মতো ধর্মতলামুখী একের পর এক মিছিল। মঞ্চের সামনে থেকে জওহরলাল নেহরু রোডের উড়ালপুলের মুখ পর্যন্ত তখনই কানায় কানায়। একই অবস্থা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকেও। কী ‘অঙ্গীকার’ আজ করবেন নেত্রী? অধীর আগ্রহে হাজার হাজার। অভিষেক তো বটেই, বেশ কয়েক জন সিনিয়র নেতার ভাষণেও আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল, মমতার বার্তা কী হতে চলেছে। কণ্ঠস্বরে প্রত্যাশিত তীব্রতা নিয়েই মমতা বললেন, ‘‘২০১৯-এ বিজেপি যাবেই।’’ তার পরে প্রত্যাশা ছাপিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘আগামী দিনে পার্লামেন্টে পথ দেখাবে তৃণমূল।’’
লোকসভা নির্বাচনের আগে এই শেষ শহিদ স্মরণ। ভোটের বাদ্যি তৃণমূলনেত্রী এই সমাবেশ থেকেই যে বাজিয়ে দেবেন, রাজনৈতিক শিবিরের তা জানাই ছিল। ২০১৭-র শহিদ দিবসেই প্রথম বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যে, এ বার লক্ষ্যস্থির করছেন দিল্লিতে। এক বছর কাটিয়ে সেই ঘোষণাই অঙ্গীকারে পরিণত। মমতা বললেন, ‘‘একুশে দিচ্ছি ডাক, বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ থাক, বিজেপি গোল্লায় যাক।’’
আরও পড়ুন
বৃষ্টি মাথায় করে সাইকেল দেওয়া ‘দিদি’কে দেখে গেল অনির্বাণ
শহিদ সমাবেশের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন রকম ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন বিজেপিকে। ভোটে হারানোর চ্যালেঞ্জ, জোটে হারানোর চ্যালেঞ্জ, জমায়েতে হারানোর চালেঞ্জ।
ভিড়ে থিক থিক ধর্মতলা চত্বর। ছবি: পিটিআই।
নীতি-আদর্শ সংক্রান্ত বিষয়ে বিজেপি-কে তথা কেন্দ্রীয় সরকারকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন তীব্র আক্রমণ করেন। তবে সে আক্রমণে যাওয়ার আগে তিনি জমায়েতের চ্যালেঞ্জটা ছোড়েন বিজেপির দিকে। কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার ঠিক পাঁচ দিন আগে মেদিনীপুরে সভা করে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। সে সভার কথা উল্লেখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, চলতি মাসের ২৮ তারিখে ওই মাঠে তৃণমূলের সভা হবে। কারা যোগ দেবেন সে সভায়, নামের ঘোষণা করে দেন তৃণমূলনেত্রী। তীব্র কটাক্ষ ছুড়ে বলেন, ‘‘আঠাশে জুলাই ওই মেদিনীপুর গ্রাউন্ডেই সভা হবে। যেখানে বিজেপি প্যান্ডেল করতে পারেনি। প্যান্ডেল করতে গিয়ে প্যান্ডেল ভেঙে ফেলে, তারা নাকি আবার দেশ গড়বে।’’
তৃণমূলের শহিদ স্মরণের মঞ্চ থেকে শনিবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
এতেই অবশ্য শেষ নয়, অগস্টে কী কী কর্মসূচি থাকছে, তাও জানিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরেই নেত্রীর বার্তা, উৎসবের মরসুমটা পার করেই ফের নভেম্বর থেকে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে, প্রস্তুতি ব্রিগেড সমাবেশের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন জানিয়েছেন, ২০১৯-এর ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে জনসভা হবে। প্রস্তাবিত ফেডেরাল ফ্রন্টের সব দলকে সেই মঞ্চে আনা হবে বলেও মমতার ঘোষণা। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শপথ নেওয়া হবে ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে, মমতার বার্তা অনেকটা এ রকমই। তাঁর কথায় ‘উনিশে সমাবেশ উনিশ দখলের জন্য’। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আঞ্চলিক মহারথীদেরকে ব্রিগেড সমাবেশে এনে দ্বিমুখী লাভের অঙ্ক মিলিয়ে ফেলতে চাইছেন মমতা। লালুপ্রসাদ যাদব, শরদ পওয়ার, এম কে স্ট্যালিন, কে চন্দ্রশেখর রাও, এন চন্দ্রবাবু নায়ডু, এইচ ডি কুমারস্বামী, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, অরবিন্দ কেজরীবালদের পাশে নিয়ে বাংলাকে মমতা দেখাতে চাইবেন, জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্বটা এখন ঠিক কী রকম। উল্টো দিকে ব্রিগেড সমাবেশের মতো বিশাল জমায়েতের সামনে ওই নেতাদের দাঁড় করিয়ে মমতা বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, বাংলায় তাঁর জনভিত্তি এখনও ঠিক কতটা দৃঢ়।
দেখুন ভিডিয়ো...
শহিদ স্মরণ বা অঙ্গীকার গ্রহণের মঞ্চ থেকে মমতার ভাষণের এই পর্বটা যদি হয় বিজেপি-কে জমায়েতে টেক্কা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছোড়ার জন্য নিবেদিত, তা হলে সমান্তরাল ভাবেই চলছিল ভোটে বিজেপি-কে পর্যুদস্ত করার ডাক দেওয়াও। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ইতিমধ্যেই একাধিক বার বলেছেন, ২০১৯-এর নির্বাচনে বাংলা থেকে অন্তত ২২টি লোকসভা আসন জেতার লক্ষ্য নিয়ে নামছে বিজেপি। সে প্রসঙ্গে একটি কথাও না বলে এ দিন স্রেফ উপেক্ষার নীতি নিলেন মমতা। আর ‘৪২টা আসনই মানুষের ভোটে নেব’ বলে মন্তব্য করে বুঝিয়ে দিলেন, বিজেপি-র যে দু’টি আসন এ রাজ্যে এখন রয়েছে, সে দু’টিও পরের নির্বাচনে যাতে ধরে রাখতে না পারেন অমিত শাহরা, তৃণমূল সেই লক্ষ্য নিয়েই ঝাঁপাবে।
জনজোয়ার। ছবি: পিটিআই।
জোটের প্রশ্নেও বিজেপি-র দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশজোড়া ফেডেরাল ফ্রন্টের স্পষ্ট ঘোষণা তো তিনি করলেনই। পাশাপাশি কটাক্ষ ছুড়ে দিলেন লোকসভায় মোদী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আসা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে। মমতার বার্তা— অনাস্থায় সরকার পক্ষ জিতেছে ঠিকই, কিন্তু এই জয় দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে নয়। অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে পড়েছে ৩২৫টি ভোট। আর পক্ষে মাত্র ১২৬টি। দেশ জুড়ে বিজেপি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে বলে যখন বিরোধী দলগুলি দাবি করছে, তখন লোকসভার অন্দরে ভোটাভুটিতে এই বিপুল জয় নরেন্দ্র মোদীদের স্বস্তি দিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু মোদী তথা বিজেপি-কে স্বস্তিতে থাকতে দিতে যে তিনি একেবারেই চান না, এ দিনের ভাষণে অনাস্থা প্রসঙ্গ টেনে সে কথা ফের এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেছেন, ভোটাভুটিতে বিজেপি যে সংখ্যা পেয়েছে, সেটা ২০১৪-র সংখ্যা, ২০১৯-এর সংখ্যা নয়।’’ তাঁর ব্যাখ্যা— ২০১৪ সালের রায়ের ভিত্তিতে লোকসভার অন্দরে ওই ফলাফল হয়েছে, লোকসভার বাইরের পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ বিপরীত।
আরও পড়ুন
দফায় দফায় বৃষ্টি মাথায় করেই ধর্মতলামুখী তৃণমূল কর্মীরা
অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বিজেপি-র প্রাক্তন শরিক তেলুগু দেশম, অনাস্থা প্রস্তাবে বিজেপি-কে সমর্থন করেনি তাদের বর্তমান শরিক শিবসেনা, ভোটদানে বিরত থেকেছে বাজপেয়ী জমানার বিজেপি শরিক বিজু জনতা দল— নিজের ভাষণে এ দিন সে কথা মনে করিয়ে দেন মমতা। জয়ললিতা বেঁচে থাকলে এআইএডিএমকে-র ভোটও বিজেপি-র দিকে যেত না বলে তিনি দাবি করেছেন। তার পরেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক হিসেব তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ২০১৯-এর নির্বাচনে এক-দেড়শো আসনেই থেমে যাবে বিজেপি। বিহারে লালুর কাছে, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ-মায়াবতী জোটের কাছে, তেলঙ্গানায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের কাছে, তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিনের কাছে বিজেপি-কে হারতে হবে বলে মমতা এ দিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেসের নাম এক বারও উচ্চারণ করেননি মমতা। মধ্যপ্রদেশে, রাজস্থানে, গুজরাতে বিজেপির ফল খারাপ হবে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন দাবি করেন। কিন্তু কাদের কাছে ওই সব রাজ্যে বিজেপি হারবে, তা মমতা উল্লেখ করেননি। শুধু পঞ্জাবের কথা বলেছেন, কিন্তু কংগ্রেসের নাম না করে বলেছেন, ‘‘ওখানে অমরেন্দ্র সিংহ বিজেপি-কে খেয়ে নেবেন।’’
বৃষ্টি মাথায়। ছবি: এএফপি।
ফেডেরাল ফ্রন্টের প্রস্তাব নিয়ে যে দিন থেকে সক্রিয় হয়েছেন মমতা, সে দিন থেকেই কংগ্রেসকে ওই ফ্রন্টের বাইরে রাখার প্রশ্নে অনড় তিনি। শরদ পওয়ার, লালু যাদব, স্ট্যালিনরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোটের পক্ষে সওয়াল করেছেন। কিন্তু মমতা স্পষ্ট জানিয়েছেন, বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির জোটে কংগ্রেসকে তিনি চান না। এ দিনও কংগ্রেসের নাম না করে মমতা বার্তা দিয়ে দিলেন, নিজের সেই অবস্থানেই তিনি অনড় রয়েছেন।
আর রাজ্য রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে বামেদের কিছুটা আক্রমণ করলেন তিনি। দিল্লিতে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়তে তৃণমূলের সাহায্য নেওয়া হবে আর বাংলায় বিজেপির হাত শক্ত করা হবে, এমনটা চলতে পারে না— বার্তা মমতার। বাংলায় তৃণমূলের কোনও জোট দরকার নেই, লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এ রাজ্যে একাই ভাল লড়বে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন সে কথা। সেই সঙ্গে অনুচ্চারিত বার্তাও দিয়ে দিয়েছেন— এ রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের শক্তিকে আর ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না তিনি।