তাঁর প্রিয় তত্ত্ব ‘চক্রান্ত’। আর তিনি জানেন, দলকে টেনে তুলতে তাঁর নিজের পথে নামাই সেরা দাওয়াই। সারদা-কাণ্ডে কোণঠাসা তৃণমূলের জন্য ঠিক সেটাই করতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আজ, সোমবার মমতার নেতৃত্বেই কলকাতায় পথে নামছে তৃণমূল।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সিবিআইকে তাঁদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হচ্ছে, সারদা তদন্তের শুরু থেকেই সেই অভিযোগ করে আসছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সিবিআই তদন্তের ফাঁস যত চেপে বসছে, অভিযোগের মাত্রা তত জোরালো হচ্ছে। দলের রাজ্যসভা সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকে সিবিআই গ্রেফতার করার পরে এখন আরও প্রমাদ গুনছেন মমতা। দিল্লিতে সংসদ থেকে কলকাতার রাজপথ, সর্বত্রই তিনি এ বার নামতে চাইছেন চূড়ান্ত কেন্দ্র বিরোধিতায়। আক্রমণই সেরা রক্ষণ, এই কৌশলকে হাতিয়ার করে আজ কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত তৃণমূলের মিছিলের প্রধান মুখ স্বয়ং মমতাই।
সারদা-কাণ্ডে এই মিছিলের জন্য নিজের কর্মসূচিও পরিবর্তন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমে ঠিক ছিল, আজ উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় সরকারি কর্মসূচি সেরে হেলিকপ্টারে দিঘা চলে যাবেন তিনি। কপ্টার বনগাঁয় মজুতই থাকছে। তবে দিঘা নয়, মমতাকে কলকাতায় উড়িয়ে আনার জন্য। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঠিক হয়েছে, সকালে বনগাঁ গিয়ে সরকারি কর্মসূচি সেরে সেখান থেকে কপ্টারে রেসকোর্সে এসে নামবেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে মিছিল সেরে সন্ধ্যায় সড়ক পথে সম্ভাব্য গন্তব্য দিঘা।
তবে যে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৃণমূল নেত্রীর এত দৌড়ঝাঁপ, তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে দলেই। দলের একাংশের বক্তব্য, মমতা অভিযোগ করছেন সনিয়া গাঁধীর ডাকে দিল্লি যাওয়ার মাসুল হিসাবে সাংসদ সৃঞ্জয়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, দিল্লি সফরে অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহদের মতো বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তাতে যখন ‘কাজের কাজ’ কিছু হয়নি দেখাই যাচ্ছে, এর পরে সংসদের ভিতরে-বাইরে সর্বাত্মক বিজেপি-বিরোধিতায় গেলে হিতে আরও যে বিপরীত হবে না, তার কি নিশ্চয়তা?
সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে আজ, সোমবারই। তার আগে রবিবার সংসদের সর্বদল বৈঠক বয়কট করেছে তৃণমূল। সাংসদদের প্রতি মমতার নির্দেশ, কালো টাকা থেকে বিমা বেসরকারিকরণ বিল নানা প্রশ্নে সংসদ প্রায় অচল করে দিতে হবে। নির্দেশ মানতে বাধ্য হলেও মনে প্রবল সংশয় আছে সাংসদদের একাংশের। এক সাংসদের কথায়, “সঙ্কটের সময় প্রতি পদক্ষেপ মেপে ফেলাই ভাল। জেলায় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি থাকলে দিল্লিতে যে প্রতি দিন থাকা হবে না, দলনেত্রীর কাছ থেকেই সেই অনুমতি নিয়ে রেখেছি।”
কলকাতায় মিছিলের জন্যই আজ বেশির ভাগ সাংসদকে থেকে যেতে বলা হয়েছে। তবু কত জন মিছিলে থাকবেন, এখনও স্পষ্ট নয়। তৃণমূল সূত্রের খবর, বাম আমলের শেষ দিকে সিপিএমের ‘খেজুরি পুনর্দখলে’র বর্ষপূর্তির কর্মসূচি উপলক্ষে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী থাকবেন পূর্ব মেদিনীপুরে।
উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের কয়েক জন সাংসদ এ দিনই চলে গিয়েছেন দিল্লি। মমতা অবশ্য চাইছেন, মিছিলে বিরাট জনসমাগম ঘটিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা অটুট থাকার বার্তা দিতে। তৃণমূল নেত্রীর সাফ কথা, “আমাকে আঘাত করলে রাজনৈতিক ভাবে প্রত্যাঘাত হবে। আমাকে দুর্বল ভাববেন না! সারা জীবন লড়াই করে কেটেছে। গণতান্ত্রিক ভাবেই আমি জবাব দেব।”
বিরোধীরাও মমতার জবাব চাইছেন। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ যেমন বলেছেন, “সিবিআই নাকি অমিত শাহের নির্দেশে চলছে! ওঁর কাছে এমন তথ্য থাকলে তা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে দিন না! আসলে ওঁর কাছে এমন তথ্য নেই।” সারদার টাকা নেওয়ায় ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান ক্লাবের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করা হয়েছে। তা হলে একই যুক্তিতে তৃণমূলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করা হবে না কেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন রাহুলবাবু।
মমতার আরও অভিযোগ, সনিয়ার আমন্ত্রণে দিল্লিতে জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বলে সৃঞ্জয়কে গ্রেফতার করে ‘বাঁশ’ দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় দু’টি কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি এ দিন পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, “তা হলে আমাকেও গ্রেফতার করা উচিত! আমি ওখানে গিয়েছিলাম।” কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী সত্যি কথা বলছেন না। সনিয়াজি ওঁকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি তো নিমন্ত্রণ রক্ষাই করেননি!”
দমদমে এ দিনই উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেসের সদস্যকরণ অভিযান শুরু করতে গিয়ে প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী, এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক সি পি জোশী, বিধায়ক মানস ভুঁইয়া, জেলা সভাপতি তাপস মজুমদার সকলেই বলেছেন, তৃণমূলের অত্যাচার এবং বিজেপি-র আগ্রাসন রুখতে হবে কংগ্রেসকেই।