Mamata Banerjee

ভার্চুয়ালের বিরাট আয়োজন, কিন্তু আবেগের একুশ চাইছে ধর্মতলা ছুঁতে

এ বছর যেন সব কিছু থেকেও কিছুই নেই। একুশে জুলাই রয়েছে, কিন্তু ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে জমজমাট মঞ্চ নেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২০ ১৯:৩৫
Share:

এই দৃশ্য দেখা যাবে না এ বছর। —ফাইল চিত্র।

বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারিখ তৃণমূলের জন্য। বছরের সবচেয়ে বড় সমাবেশের তারিখ। ভিক্টোরিয়া হাউসের উঠোনে বাঁধা মঞ্চের সামনে থেকে এক দিকে প্রায় পার্ক স্ট্রিটের মুখ আর অন্য দিকে যোগাযোগ ভবনের মোড় পর্যন্ত ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে থেকে নেত্রীর আগুনে ভাষণে উদ্বেল হওয়ার তারিখ। চড়া রোদে পুড়তে পুড়তে আচমকা মেঘ করে আসার তারিখ। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে কোনও হেলদোল না দেখিয়ে ভিজতে থাকার তারিখ। কারণ জুলাইয়ের ভ্যাপসা গরমে দরদর করে ঘামতে থাকা যে নেত্রী সবুজ পেড়ে সাদা শাড়ির আঁচলে কপাল-মুখ-গলা মুছে নেন, খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনিও তো ভেজেন এই তারিখে। আর বলেন, বৃষ্টি আমাদের জন্য শুভ, বৃষ্টি হল শহিদদের জন্য প্রকৃতির চোখের জল।

Advertisement

এ বছর যেন সব কিছু থেকেও কিছুই নেই। একুশে জুলাই রয়েছে, কিন্তু ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে জমজমাট মঞ্চ নেই। শহিদ স্মরণ রয়েছে, কিন্তু ধর্মতলায় ‘দিদি’র আসার কথা নেই। প্রস্তুতি খতিয়ে দেখার বিকেলটা যেমন অন্যান্য বছরও বৃষ্টিবিঘ্নিত হয়, এ বারও প্রায় তেমনই, কিন্তু সেই প্রস্তুতিই নেই। শহিদ স্মরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ হওয়ার কথা রয়েছে, কিন্তু জনপ্লাবনে কলকাতার রাস্তাঘাট ভাসিয়ে দিয়ে শক্তিপ্রদর্শন করার সুযোগ নেই।

এই প্রথম বার শহিদ স্মরণ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সারতে হচ্ছে তৃণমূলকে। একুশে জুলাই আশুতোষ-মূর্তির সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দলের সভা হচ্ছে না, এমন নজির রয়েছে। কোনও বছর সভা ব্রিগেডে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোনও বছর নির্বাচনের কারণে সভার তারিখ বদল হয়েছে। কিন্তু শহিদ স্মরণে সভা হচ্ছে, অথচ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের আবেগ-নস্ট্যালজিয়ায় কলকাতার রাজপথ ভেসে যাচ্ছে না, এমন কখনও হয়নি। কোভিড কিন্তু তেমন বেনজির পরিস্থিতিই তৈরি করে দিল। ফলে ভার্চুয়াল সভার সর্বাত্মক সাফল্যের জন্য সব স্তরে প্রস্তুতি চলার মাঝেও আক্ষেপ যেন যাচ্ছেন না পুরনো তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের। সে তালিকায় সাধারণ বুথ স্তরের কর্মী বা ব্লক স্তরের নেতা যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন সাংসদ থেকে মন্ত্রীও।

Advertisement

আরও পড়ুন: সপ্তাহে ২ দিন রাজ্যে সম্পূর্ণ লকডাউন, এ সপ্তাহে বৃহস্পতি এবং শনিবার​

মাসখানেক আগেই জানা গিয়েছিল, এ বার ২১ জুলাই ধর্মতলায় সমাবেশ হচ্ছে না। কোভিড সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যে সামাজিক দূরত্ব বিধি অপরিহার্য আজ, তার কারণেই সমাবেশ করা যাবে না। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জানিয়েছিলেন সে কথা। তবে সমাবেশের তারিখ কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া হবে, নাকি ২১ তারিখেই ভার্চুয়াল সভা করা হবে, সে সিদ্ধান্ত তখনও হয়নি। পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছিল রাজ্যের শাসক দল। ক্রমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আপাতত বেশ কিছু মাস জমায়েতের পরিস্থিতি থাকবে না। সুতরাং ২১ জুলাইতেই ভার্চুয়াল সভা করার সিদ্ধান্ত হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল সমাবেশের বিজ্ঞাপন।

সংক্রমণ ঠেকাতে কলকাতার বুকে নিজেদের সবচেয়ে বড় বাৎসরিক জমায়েত তৃণমূল বাতিল করেছে বটে। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম মাইলফলক। প্রবল লড়াকু নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠার যে যাত্রাপথ মমতার, সে পথে ২১ জুলাই এক মোড় ঘোরানো তারিখ। অতএব সেই মাইলফলককে স্মরণ করার কর্মসূচি কোনও পরিস্থিতিতেই দায়সারা ভঙ্গিতে সেরে ফেলতে পারে না তৃণমূল। ভার্চুয়াল সভার আয়োজনও তাই কোমর বেঁধেই হয়েছে।

অন্যান্য বছর রাজ্যের সব প্রান্ত থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ২১ জুলাই হাজির হতেন ধর্মতলায়। এ বছর যে হেতু কলকাতায় আসতে হচ্ছে না, সে হেতু রাজ্যের প্রত্যেকটা বুথে শহিদ স্মরণের আয়োজন করতে বলা হয়েছে কর্মীদের। এ বারের শহিদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ গান বানিয়েছে তৃণমূল। ২১ জুলাই সকাল থেকে বুথে বুথে সেই গান বাজাতে বলা হয়েছে। প্রত্যেক বুথে শহিদবেদী তৈরি করে শ্রদ্ধা জানাতে এবং দলের পতাকা উত্তোলন করতে বলা হয়েছে। তবে দুপুর ১টা থেকে ২টোর মধ্যে সেই সব বুথভিত্তিক কর্মসূচি সেরে ফেলতে হবে। দুপুর ২টোয় শুরু হবে দলের চেয়ারপার্সন তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ।

ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে শহিদ তর্পণের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও থাকছে। তৃণমূলের তরফে দলের রাজ্য সভাপতি তথা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী যাবেন ধর্মতলার সেই শহিদ স্মরণের আয়োজনে। শহিদবেদীতে মালা দেবেন তিনি। তৃণমূল ভবনেও পতাকা উত্তোলন করবেন সুব্রত বক্সীই। তবে সে সব সেরে ২টোর অনেকটা আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে তাঁর পৌঁছনোর কথা বলে তৃণমূল সূত্রে সোমবার জানা গিয়েছে। সুব্রত বক্সী ছাড়াও, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় থাকবেন মমতার সঙ্গে। ফিরহাদ হাকিম এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও থাকতে পারেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কালীঘাটের বাড়ি থেকেই ভাষণ দেবেন এ বার। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ শোনা যাবে মমতার কথা। বুথে বুথে মাইক লাগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শোনানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কর্মীদের। সোশ্যাল মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষ এ বারের ভার্চুয়াল সমাবেশ শুনবেন— বলছেন তৃণমূলের সোশ্যাল মিডিয়া সেলের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। তাঁদের দাবি, ধর্মতলায় প্রতি বছর এই দিনে যে জমায়েত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি লোকের কাছে এ বার লাইভ পৌঁছে যাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ। ভার্চুয়াল সভার আয়োজন সে ভাবেই করা হয়েছে বলে রাজ্যের শাসক দলের সোশ্যাল মিডিয়া সেলের একাংশের দাবি।

আরও পড়ুন: সিইএসসি নতুন বিল না পাঠানো পর্যন্ত টাকা দেবেন না, আবেদন বিদ্যুৎমন্ত্রীর

ভাষণ যত মানুষের কাছেই পৌঁছক, একুশের ধর্মতলা কিন্তু পুরনো তৃণমূলকর্মীদের কাছে অন্য রকমের আবেগ। তাই ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে নেত্রীর ভাষণ যত মানুষের কাছেই পৌঁছে যাক, ধর্মতলার আবেগাপ্লুত জমায়েতকে এ বার মিস করবেন অনেকেই। শাসক দলের অনেক নেতাই সে কথা জানাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী তথা রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী তাপস রায়ের কথায়, ‘‘এই দিনটার গুরুত্ব আমাদের কাছে তো বরাবরই অন্য রকম। কলকাতার বুকে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীকে যে দিন গুলি করে মেরেছিল সিপিএমের পুলিশ, সেই দিনও তো আমরা গোটা ঘটনাপ্রবাহের শরিক ছিলাম। আমাদের কাছে এটা কত বড় আবেগের দিন, সেটা নতুনদের অনেকে হয়তো বুঝবেন না।’’ তাপসের কথায়, ‘‘সিপিএমের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আমাদের করতে হয়েছে। সে লড়াইয়ে আমাদের অনেক সহকর্মী শহিদ হয়ে গিয়েছেন। সংখ্যাটা একটা-দুটো নয়, হাজার হাজার। আমি বা আমরা কেউ কেউ হয়তো বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু এই তারিখটা আমাদের আজও সেই দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।’’

তা হলে এ বার নিশ্চয়ই ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, এ বার তো আর ধর্মতলায় যাওয়া নেই, এ বার তো ঘরে বসেই নেত্রীর ভাষণ শোনা...

তাপস বললেন, ‘‘ফাঁকা তো লাগবেই। এখন থেকেই লাগছে। তবে ধর্মতলায় একবার যাবই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement