ফাইল চিত্র।
শুরুতে সেই গোপালনগরই!
দশ বছর আগে সিঙ্গুরের গোপালনগর থেকে শুরু হয়েছিল শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ। আজ, বৃহস্পতিবার সেখান থেকেই উলট-পুরাণের শুরু!
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো টাটাদের ন্যানো কারখানার জন্য অধিগৃহীত জমি চাষিদের ফিরিয়ে দিতে গত মাসের গোড়া থেকেই উদ্যোগী হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। একই সঙ্গে চলছে সেই জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার কাজও। গোপালনগর মৌজার ওই চাষজমিই ফিরিয়ে দিতে আজ, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টো নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা সিঙ্গুরে আসছেন।
মঙ্গলবার এই সিঙ্গুরেই গাড়ি দুর্ঘটনায় জখম হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তা নিয়ে মমতা উদ্বেগেও রয়েছেন। তবে, এ জন্য পূর্ব ঘোষণামতো সিঙ্গুরে মমতার জমি বিলির অনুষ্ঠানের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে বুধবারেও সিঙ্গুরে আসেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
প্রশাসন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ১৫ জন মন্ত্রী থাকবেন। গোপালনগরের ঘোষপাড়ায় মঞ্চ তৈরি হয়েছে। সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের পরে মমতা সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়বেন। ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক মিলিয়ে গোপালনগরের মধ্যপাড়া ও ঘোষপাড়ার ২১ জন চাষিকে (৫ জন ইচ্ছুক, ১৬ জন অনিচ্ছুক) তিনি প্রতীকী ভাবে জমির ‘ফিজিক্যাল পজেশন’ দেবেন। যে জমির পরিমাণ প্রায় ৬.৭১ একর। একই সঙ্গে তাঁদের দেওয়া হবে বেগুন-সর্ষের চারা, বীজ এবং সার। যাতে অবিলম্বে ওই জমিতে চাষিরা চাষ করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর পরে অন্য মন্ত্রীরাও জমি বিলি করবেন। এ দিনই আড়াই হাজার চাষিকে মোট ১০০ একর জমি বিলি করা হবে। অনুষ্ঠানে বাইরে থেকে কোনও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের এনে ভিড় বাড়ানো হবে না বলে হুগলি জেলা তৃণমূলের এক নেতা জানিয়েছেন। গোটা অনুষ্ঠানই হবে সিঙ্গুরের মানুষদের নিয়ে। এতদিন বাদে জমি ফিরে পাবেন, উত্তেজনায় ফুটতে শুরু করেছেন গোপালনগরের চাষিরা।
বার্তালাপ। সিঙ্গুরে সভামঞ্চ তৈরির কাজ দেখার পরে চাষিদের সঙ্গে কথা বললেন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বুধবার দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।
কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, ‘‘ওখানকার চাষিরা শুরুতে সর্ষে চাষ করবেন। সেই কারণে শুরুতে তাঁদের সর্ষে বীজ বিলি করা হবে। এর পরে ওঁরা যেমন সাহায্য চাইবেন, কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হবে। জৈব সারও বিলি করা হবে।’’ ওখানে চাষে জলের সমস্যা থাকায় একটি মিনি ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও মন্ত্রী জানান।
২০০৬ সালে টাটা গোষ্ঠীর গাড়ি কারখানা গড়তে সিঙ্গুরে প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। ১০ বছর পর, গত অগস্টের শেষ দিকে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ওই অধিগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে জমি কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টে এই ঐতিহাসিক জয় পাওয়ার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঘোষণা করেন, ওই জমিকে চাষযোগ্য করেই ফেরানো হবে। সেই মতো শুরু হয়ে যায় কাজও। ইতিমধ্যে বহু চাষিকে জমির পরচা এবং ক্ষতিপূরণ বিলি করা হয়েছে। তবে, কেউ এখনও ‘ফিজিক্যাল পজেশন’ পাননি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর চুঁচুড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সেই মালিকানা দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেন ২০ অক্টোবর। তাই পুজোতেও বিরাম মেলেনি প্রশাসনের কর্তা থেকে সাধারণ কর্মীদের। পুলিশও দিনরাত এক করে কাজ করে গিয়েছে।
পুজো মিটে গিয়েছে। গোপালনগরে শিল্পের জন্য নেওয়া জমি এখন পুরোপুরি কাঁচামাটির ধূ ধূ প্রান্তর। ইতিউতি কাশ। জমির মালিকানা কংক্রিটের ছোট ছোট খুঁটি দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। বড় ছাতার তলায় বসে বুধবারও কাগজপত্র মেলানোর কাজ করে গিয়েছেন সরকারি কর্মীরা। প্রথম পর্বের জমি বিলির জন্য কেন গোপালনগরকেই বাছা হল, তা নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতা বা মন্ত্রীরা মন্তব্য করেননি। তবে, দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন, যেহেতু অধিগ্রহণ সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল, তাই জমি বিলিও সেখান থেকেই হচ্ছে।
তবে, প্রশাসন জানিয়েছে, গোপালনগরের জমিকে সহজে এবং তাড়াতাড়ি চাষযোগ্য করা গিয়েছে। ওখানে টাটাদের কোনও শেড ছিল না। শুধু বিদ্যুতের একটি সাব-স্টেশন সরাতে হয়েছে। বুধবার চাষের জমি বারে বারে এসে দেখে গিয়েছেন চাষিরা। তাঁদেরই এক জন জয়দেব ঘোষ। টাটা প্রকল্পে তাঁর ১২ বিঘা জমি গিয়েছে। মমতার হাত থেকে আজ যাঁরা জমি পাবেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জয়দেবও। তিনি বলেন, ‘‘শিল্পের জন্য জমি দিয়েছিলাম। এখন ফেরত পাব জেনে ভালই লাগছে। আবার ওখানে চাষ করব।’’ জয়দেবের সুরেই আর এক গ্রামবাসী মালতি ঘোষ বলেন, ‘‘জমি ফেরত পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি। আড়াই বিঘে জমি আছে ওখানে। সেই সময় ক্ষতিপূরণও নিইনি। অসম্ভবকে সম্ভব করল সরকার।’’
প্রশাসন সূত্রে খবর, গোপালনগরে ৪১৫ একর জমি এখনই চাষের জন্য উপযোগী করে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে সিঙ্গুরের ৮০ শতাংশ জমি চাষের উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে। ৭৫ একর জমিতে কারখানার শেড, জলাভূমি ও রাস্তা রয়েছে। ফলে, সেই জমিকে চাষযোগ্য করতে কিছু সময় লাগবে। জমির মালিকানা নিয়ে কয়েকটি ক্ষেত্রে যে জটিলতা রয়েছে, তা শুনানির মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে।
দ্রুত বৃত্ত সম্পূর্ণ করে সিঙ্গুর ফিরতে চলেছে পুরনো চেহারায়।
ফেরত পর্ব
• ২১ চাষিকে জমি দেবেন মমতা। বিলি হবে বীজ, সারও
• মোট ১০০ একর জমির মালিকানা পাবেন ২৫০০ চাষি
• গোপালনগরের ঘোষপাড়ায় অনুষ্ঠান-মঞ্চ
• নিরাপত্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা, হাজার পুলিশ
• থাকছেন না বাইরের তৃণমূল কর্মী-সমর্থক