বিরোধীশূন্য পুরসভার ডাকে প্রশ্ন তৃণমূলেই

একেবারে নটে গাছটি মুড়িয়ে দিন! ঠিক এই ভাষায় না-হলেও চাহিদাটা প্রায় এই রকমই! রাজ্যের সব পুরসভাকেই বিরোধীশূন্য করে দিতে চাইছে শাসক দল। ভোট প্রচারে উত্তরবঙ্গে গিয়ে এ বার প্রথমেই এই সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সেই আহ্বানই এখন দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দলের অন্য নেতারা।

Advertisement

সঞ্জয় সিংহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৪:৩২
Share:

একেবারে নটে গাছটি মুড়িয়ে দিন!

Advertisement

ঠিক এই ভাষায় না-হলেও চাহিদাটা প্রায় এই রকমই! রাজ্যের সব পুরসভাকেই বিরোধীশূন্য করে দিতে চাইছে শাসক দল। ভোট প্রচারে উত্তরবঙ্গে গিয়ে এ বার প্রথমেই এই সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সেই আহ্বানই এখন দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দলের অন্য নেতারা। বিরোধীদের অভিযোগ, নেতাদের বার্তা পড়ে নিয়ে পুরসভাকে বিরোধীশূন্য করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছে তৃণমূলের ক্যাডার বাহিনী এবং তা থেকেই বাধছে অশান্তি। আবার শাসক দলের অন্দরেই একটা বড় অংশ মনে করছেন, বিরোধীদের মুছে দেওয়ার এই চেষ্টা আখেরে দলের ক্ষতিই করবে। তাঁদের আশঙ্কা, বিধানসভার নির্বাচনের আগের বছরে এতটা চরমপন্থী হওয়ার খেসারত নিজেদেরই না চুকোতে হয়!

কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে যে যা-ই বলুন, ভোটের ময়দানে দলনেত্রীর নির্দেশ মেনেই চলছেন তৃণমূলের নেতারা। তৃণমূলের ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পুরুলিয়ায় ভোট-প্রচারে বিরোধীশূন্য পুরবোর্ড গঠনের ডাক দিয়েছেন। অশোকনগরে গিয়ে অভিষেক বলেছেন, কলকাতায় ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪৪টিই
তাঁরা জিতবেন! পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে তৃণমূলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও বিরোধীশূন্য পুরসভা গড়ার কথা বলেছেন।

Advertisement

বছর দুয়েক আগে হাওড়ায় লোকসভা উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়েও এই ডাকই দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উপনির্বাচনের অব্যবহিত পরেই ছিল হাওড়া পুরসভার ভোট। মমতা সেই সময়ে জানিয়েছিলেন, পুরভোটে সব আসনে তৃণমূলকে নিয়ে আসা দরকার। রাজ্য সরকারে তৃণমূল আছে, পুরসভাতেও তৃণমূল থাকলে উন্নয়নের কাজে সমন্বয় থাকবে। তাঁর দলের নেতারা সেই আহ্বানকেই আরও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁর পিসির মতো এ দিন অভিষেকও ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘‘সব ওয়ার্ডেই যাতে একই মাত্রায় উন্নয়নের কাজ হয়, সে কারণেই সব ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীদের জয়ী করার জন্য মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। কলকাতার অভিজ্ঞতায় দেখছি, যে সব ওয়ার্ডে বিরোধী কাউন্সিলর রয়েছেন, সেখানে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হয়েছে।’’

বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, রাজ্য সরকার ইচ্ছে করেই উন্নয়নের কাজে বিরোধীদের বাধা দিয়ে আসছে। তার পর প্রচার করা হচ্ছে যে, বিরোধীরা ক্ষমতা পেলে উন্নয়ন হবে না। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘বিরোধী দলের হাতে পুরসভা, পঞ্চায়েত বা এমনকী, জেলা পরিষদ থাকলেও তারা যে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছে না, গত চার বছরে বারবার দেখা গিয়েছে। এখন আবার তৃণমূল নেতারা উল্টে বলছেন, বিরোধীদের হাতে বোর্ড থাকলে নাকি উন্নয়ন হবে না! আসলে বিরোধীদের হাতে ক্ষমতা গেলে রাজ্য সরকার অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক উপায়ে উন্নয়নের কাজে সহায়তা বন্ধ করে দেবে।’’

বিরোধীদের দাবি, উন্নয়নের প্রশ্নটি আদতে মুখের কথা। শাসক দলের আসল লক্ষ্য হল, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল। বিধানসভা নির্বাচনের আগের এই বছরে সব ক’টি পুর-আসন জিতে রাজ্যে ক্ষমতায় ফেরার পথটিই কণ্টকশূন্য করতে চায় তৃণমূল। কলকাতা এবং অন্যত্র পুরভোট ঘিরে ব্যাপক অশান্তির নেপথ্য কারণ আসলে এই বিরোধীশূন্য ক্ষমতা হাতে পাওয়ার তাগিদই! নইলে কলকাতার প্রাক-নির্বাচনী জনমত সমীক্ষা তৃণমূলের মসৃণ জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করার পরেও শহর জুড়ে সন্ত্রাস চালানোর দরকার ছিল না! আর এইখানেই শঙ্কা খোদ শাসক দলের অন্দরমহলেই। তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা-মন্ত্রীদের একটা বড় অংশ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করছেন, কাজটা ভাল হচ্ছে না।

কেন? শাসক দলের একাংশের মত হলো, বিরোধীশূন্য করার এই প্রবণতা ভবিষ্যতে ব্যুমেরাং হতে পারে! তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার হুঁশিয়ারি, ‘‘এক বার এই পথ দেখালে পরে আমাদেরই পস্তাতে হবে। আজ যাঁরা ক্ষমতায় নেই, তাঁরা যে দিন আসবেন, সে দিন তাঁদের সরানো কঠিন হবে!’’ আজ যাঁরা বিরোধীদের শূন্য করার ডাক দিচ্ছেন, তাঁদের ‘শেষের সে দিনের কথা’ মাথায় রাখতে বলছেন ওই নেতা। এবং অতীতের অভিজ্ঞতা তাঁর কথাকেই সমর্থন করছে। বাম আমলে অনিল বসুর আরামবাগ বা নন্দরানি ডল-এর কেশপুর যে ভাবে বিরোধীদের মুছে ফেলেছিল, তার মূল্য পরে ঠিক একই ভাবে চুকিয়েছেন বামেরা। সেই দৃষ্টান্ত ভুলে গিয়ে একই পথে হাঁটলে অদূর ভবিষ্যতে তৃণমূলের জন্যও একই ‘উপহার’ অপেক্ষা করে থাকবে, মনে করছেন ওই নেতারা। সুতরাং রাজনৈতিক কৌশলগত ভাবেই বিরোধীদের ‘বুলডোজ’ করার এই প্রবণতা দলের পক্ষে ক্ষতিকর হবে বলে তাঁদের মত।

আরও একটি দিক থেকেও বিরোধীশূন্য করার এই চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা বাড়াবে বলে আশঙ্কা। সেটা কী? বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে হলে ভোটে অনেক বেশি গা-জোয়ারি করার প্রয়োজন হবে। যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এই অগণতান্ত্রিক আচরণ দলের ভাবমূর্তিতে কালি ফেলবে এবং আখেরে জনসমর্থন কমাবে বলেও মনে করছেন শাসক দলেই বড় অংশ। বিরোধীরাও এই নিয়ে যথারীতি সরব হয়েছেন। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলছেন, ‘‘বিরোধীশূন্য পুরবোর্ডের যে তত্ত্ব তৃণমূল নেতৃত্ব খাড়া করছেন, তাতে তো বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামো এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই তুলে দেওয়া উচিত!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি-নীতির উপরে তৃণমূলের কোনও আস্থা নেই বলেই ওদের নেতারা এ সমস্ত বলছেন!’’ আর সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলের অভিধানে গণতন্ত্রের গ-ই নেই!’’ সিউড়ির বিক্ষুব্ধ তৃণমূল বিধায়ক স্বপন ঘোষ মনে করাচ্ছেন, বাম আমলেও বিরোধীরা বেশ কিছু পুরসভায় ক্ষমতায় ছিলেন। কলকাতা পুরসভাও পেয়েছিল তৃণমূল।

তা হলে আজ কেন এ ভাবে বিরোধীশূন্য পুরবোর্ডের কথা বলতে হচ্ছে? তৃণমূলের প্রবীণ নেতা ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় হাল্কা চালে বলছেন, ‘‘বিরোধী না-থাকলে কী করা যাবে? আমরা তো আর সরবরাহ করতে পারব না!’’ যা শুনে তৃণমূলের নেতারাই অনেকে বলছেন, বাম আমলে ঠিক এ ভাবেই বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিতেন অনিল বিশ্বাসেরা। সেই ঔদ্ধত্যের জেরে আজ সিপিএমের পায়ের তলার মাটি কতটা সরে গিয়েছে সেটা তো সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে।

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘আমাদের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করছেন বিরোধীরা। আমাদের নেতারা বলতে চেয়েছেন, যাঁরা উন্নয়ন চান না, তাঁদের শূন্য করে দিন! বিরোধীরা যদি উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে তাঁদের শূন্য করে দিলে মানুষের কোনও আপত্তি হবে না!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement