অধীর চৌধুরী।
মুর্শিদাবাদে নদীর ভাঙনও বুঝি এ বার এতটা তীব্র নয়, যত দ্রুত সেখানে ভাঙছে বিরোধী দলগুলি!
জঙ্গিপুর, জিয়াগঞ্জ ও বেলডাঙা পুরসভার পর শুক্রবার মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদেও বড়সড় ভাঙন ধরাল তৃণমূল। পরিষদের আট জন কংগ্রেস ও দুই বাম সদস্য রাতারাতি চলে এলেন রাজ্যের শাসক দলে! এর মধ্যে দু’জন আবার জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ।
৭০ আসনের মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদে গত পঞ্চায়েত ভোটে মাত্র একটি আসন জিতেছিল তৃণমূল। নির্বাচনে সাফল্য না-পেলেও ঘুরপথে জেলা পরিষদ দখলের লক্ষ্য স্থির করে নেয় তারা। নেমে পড়ে বিরোধী দল ভাঙানোর খেলায়। তাতে ধারাবাহিক ‘সাফল্য’ পেয়ে জেলা পরিষদে তৃণমূলের শক্তি বেড়ে হয়েছে ২৯। দলের তরফে মুর্শিদাবাদের পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী এ দিন রীতিমতো বুক বাজিয়ে বলেন, ‘‘জেলা পরিষদের দখল নিতে আর মাত্র ৬ জন সদস্য আমাদের প্রয়োজন। ক’দিনের মধ্যে তাও হয়ে যাবে।’’ শুভেন্দুর দাবি, মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি অচিরে মালদহ জেলা পরিষদেরও দখল নেবে তৃণমূল।
বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর গত আড়াই মাসে এ ভাবেই চারটি পুরসভার দখল নিয়েছে তৃণমূল। এর মধ্যে তিনটি মুর্শিদাবাদে। চতুর্থটি উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ। কিন্তু বাস্তব হল গত পুরভোটে এই চার পুরসভায় একটি আসনেও জেতেনি তৃণমূল। ফলে নৈতিকতার প্রশ্নটা বার বার উঠছে স্বাভাবিক ভাবেই। অনেকেই বলছেন, যাঁরা দল বদল করে তৃণমূলে যোগ দিলেন, তাঁরা আদতে তো ভোটারদের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করলেন!
মুর্শিদাবাদকে যাঁর দুর্গ বলে গণ্য করা হয়, সেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘কী ভাবে পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে, টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙানো হচ্ছে, সবাই জানে। তবে জনপ্রতিনিধি চলে যাওয়া মানেই তো ভোটার চলে যাওয়া নয়। যাঁরা কংগ্রেসের টিকিটে জিতে শাসক দলে গেলেন, তাঁদের মধ্যে সামান্যতম নৈতিকতা বেঁচে থাকলে তৃণমূলের প্রতীকে জিতে আসুন।’’ দলছুটদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে তাঁদের প্রতি কিঞ্চিৎ অভিমানও করেছেন অধীর। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের নাম পর্যন্ত মানুষ জানত না, যাঁদের বাড়ি থেকে বের করে এনে প্রার্থী করেছি, বুকের রক্ত উঠিয়ে ভোট করেছি তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করলে দুঃখ তো হবেই।’’
একই সুরে সমালোচনা করেছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের রায়কে প্রহসনে পরিণত করা হচ্ছে।’’ সূর্যবাবুর আরও অভিযোগ, বিরোধীদের দখলে থাকা পুরসভাগুলিকে সরকার কোনও সাহায্য করছে না। তাদের ঠুঁটো করে দেওয়া হচ্ছে। তার পর জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের মাধ্যমে বিরোধী কাউন্সিলরদের নানা ভাবে লুব্ধ করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এসপি-ডিএম-রা জেলা পরিষদের বিরোধী সদস্যদের ধরে ধরে এক কোটি টাকার প্রকল্পের জন্য ঠিকাদার ঠিক করে দিতে বলছেন। আশ্বাস দিচ্ছেন, সেই ঠিকাদারকে প্রথমে অস্থায়ী নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। পরে স্থায়ী করা হবে। আর ওই বিরোধী জনপ্রতিনিধিকে জেলা তৃণমূলের মুখ করে দেওয়া হবে।’’ শিলিগুড়ি পুরসভাতে এই খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এই অভিযোগ যে ঠিক তা কার্যত স্বীকার করেন নেন মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মোশারফ হোসেন ওরফে। এ দিন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। মোশারফ বলেন, ‘‘জেলা পরিষদের চেয়ার আমাদের কাছে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এলাকার মানুষের জন্য কোনও কাজই করতে পারছিলাম না। এই বর্ষায় মানুষকে সামান্য ত্রিপল দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। তাই উন্নয়নের জন্য শাসক দলে যোগ দিলাম।’’
তবে নৈতিকতার ব্যাপারে মাথা ঘামাতে রাজি নয় শাসক দল। তাঁদের মতে, নৈতিকতার বিষয়টিই যদি মুখ্য তর্ক হবে, তা হলে দলত্যাগ সংক্রান্ত আইন থাকত না। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের দশ সদস্যকে এ দিন তপসিয়ায় তৃণমূল ভাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলে সামিল করান শুভেন্দু অধিকারী। পরে তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, ‘‘এখানে নৈতিকতার কোনও যুক্তি নেই। সংবিধান মেনে, দলত্যাগ বিরোধী আইন মেনে এই যোগদান হচ্ছে।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, একের পর এক ভোটে মালদহ-মুর্শিদাবাদে বিশেষ সাফল্য না পেয়েই কি এই শর্টকাট রুট নিচ্ছে তৃণমূল? তাঁর জবাব, ‘‘২০১৩ সালের গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে এখনকার সময় বিচার করবেন না। বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদে ৩২% ভোট পেয়েছে তৃণমূল।’’
তৃণমূলের আগ্রাসনে মুর্শিদাবাদে বিরোধীদের এখন মহা দুর্দিন। এতটাই, যে সবেধন সদস্যটি তৃণমূলে নাম লেখানোয় জেলা পরিষদ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ফরওয়ার্ড ব্লক!