ব্যারাকপুর আদালতে নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। — নিজস্ব চিত্র
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবিবার জানিয়েছিলেন, বিমানবন্দরে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ ধৃত দলের নেতা নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। দল বা সরকার তাতে মাথা গলাবে না। সোমবার সকালে ব্যারাকপুর আদালতের ছবিটা কিন্তু অন্য ইঙ্গিত দিয়েছে বলে মনে করছেন বিরোধীরা।
পুলিশের ‘রাখঢাক’ থেকে শুরু করে সরকারি কৌঁসুলির ঘরে বর্ধমান থেকে আসা আইনজীবীদের ভিড়— সব কিছুতেই অেনয ধরনের ‘চাপ’ দেখেছেন বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের টুইটার-বার্তা, ‘‘বিমানবন্দরে বেআইনি অস্ত্র নিয়ে তৃণমূল নেতার ধরা পড়া ফের দেখিয়ে দিচ্ছে, তৃণমূল দলটা অপরাধী ও সমাজবিরোধীদের ডেরায় পরিণত হচ্ছে!’’ যার জবাব দিতে গিয়ে তৃণমূলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের বিবৃতি, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা বিমানবন্দরের ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন? তিনি কি নন্দীগ্রামের গণহত্যা, ছোট আঙারিয়া, সাঁইবাড়ির কথা ভুলে গিয়েছেন?’’
এতে অবশ্য বিরোধীদের থামানো যায়নি। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এ দিন দুপুর ২টো পর্যন্ত ব্যারাকপুর আদালতে সরকারি আইনজীবীর কাছে মামলার কাগজপত্রই পৌঁছয়নি! অথচ, ২টো থেকে মামলাটি শুরু হওয়ার কথা। আদালত চত্বরে তার আগেই জড়ো হতে দেখা গিয়েছে প্রচুর তৃণমূল কর্মীকে। অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করতে হাজির হয়েছিলেন দশ জন আইনজীবী, যাঁদের কয়েক জন এসেছিলেন নরেনবাবুর জেলা, বর্ধমান থেকে! নরেনবাবুর পক্ষের আইনজীবীদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছে ব্যারাকপুরের মণীশ শুক্লকে। বিরোধীদের টিপ্পনী, ২০১৪ সালে অস্ত্র আইনে অভিযুক্ত হয়েছিলেন মণীশবাবু। মণীশবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আদালতে প্রমাণসাপেক্ষ। তার আগে আইনজীবী হিসেবে আমার ভূমিকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না।’’
এজলাসে মামলা উঠতেই সরকার পক্ষের আইনজীবী পল্লব চৌধুরী ধৃতের তিন দিনের পুলিশ হেফাজতের আর্জি জানান। নরেনবাবুর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের একটি ধারায় মামলা করা হয়েছে। ব্যারাকপুর আদালতের বিচারক ধৃতকে এক দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার নরেনবাবুকে ফের আদালতে তোলা হবে। সোমবার ধৃতকে জেরা করে নতুন কী পাওয়া গেল, তার রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন বিচারক।
রবিবার গাড়িতে বাড়ি থেকে কলকাতা পৌঁছন তৃণমূলের পাণ্ডবেশ্বর ব্লক সভাপতি নরেনবাবু। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মাঝে-মধ্যেই চেন্নাই যান তিনি। তাঁর দাবি, এ বারও সেখানে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দরে এক্স-রে যন্ত্রে ধরা পড়ে, তাঁর ব্যাগে রয়েছে একটি পাইপগান ও কাগজে মোড়া তিনটি গুলি। পরে বিমানবন্দর থানা গ্রেফতার করে তাঁকে।
ওই তৃণমূল নেতা ধরা পড়তেই মুখে কুলুপ আঁটে পুলিশ। রাত পর্যন্ত ঘটনা অস্বীকার করেন পুলিশের অনেক কর্তা। এমনকী, বিমানবন্দর থানার দায়িত্বে থাকা এক আইপিএস অফিসার জানান, এমন কোনও তথ্য তাঁদের কাছে নেই! একটি সূত্রের দাবি, বিমানবন্দরে পৌঁছনোর সময় নরেনবাবুর গাড়ির আগে ছিল পুলিশের গাড়ি। যদিও বর্ধমান পুলিশ এমন কোনও ‘এসকর্ট’ দেওয়ার কথা মানতে চায়নি। ঘনিষ্ঠ মহলে বিধাননগর কমিশনারেটের একাধিক অফিসার মেনেছেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থা থানায় লিখিত অভিযোগ না করলে এটুকুও জানাজানি হতো না। আগে জানলে সব সামলানো যেত!’’ যদিও তা যায়নি। রবিবার রাতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে।
পুলিশ সূত্রে খবর, গ্রেফতার করার পরে ওই নেতাকে কিন্তু লক-আপে রাখা হয়নি। কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হল, তা নিয়ে বিস্তর রাগারাগিও করেন নরেনবাবু! রাতে কিছু মুখে তোলেননি। জেরায় পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ওই আগ্নেয়াস্ত্রের কথা জানতেন না। কেউ তাঁকে ফাঁসানোর জন্য ব্যাগে অস্ত্র রেখেছে।
নরেনবাবুর স্ত্রী অনুভাদেবীও সোমবার ফোনে বলেন, ‘‘ব্যাগ গুছিয়ে বাইরের ঘরে রেখেছিলাম। তখন দলের অনেকে বাড়িতে এসেছিল। আবার শক্তিগড়ে আমরা খাওয়ার জন্য দাঁড়াই। তখনও দলের কয়েক জন স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কেউ কোনও ফাঁকে ব্যাগে ও সব গুঁজে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’ তাঁর বড় মেয়ে সুদেষ্ণা বলেন, ‘‘বাবা কি জানবেন না যে ব্যাগে বন্দুক রাখা হলে বিমানবন্দরে পরীক্ষার সময় তা ধরা পড়বে?’’ আদালতের কাছে এ দিন একই যুক্তি দিয়েছেন নরেনবাবুর আইনজীবীরাও।
রবিবার ধরা পড়ার পরে নরেনবাবু দাবি করেছিলেন, ‘‘আমি অত্যন্ত ভাল লোক।’’ পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশ অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁদের দাবি, নরেনবাবুর অতীত নিয়ে অনেক প্রশ্নই আছে। অভিযোগ, নিজের দলের অন্য গোষ্ঠীর লোকজনকে মারধরেও বারবার নাম জড়িয়েছে তাঁর। নিজে খনিকর্মী হলেও নানা দাবিতে বিভিন্ন কোলিয়ারির কাজে বাধা দিয়েছেন। ২০১২-য় পুলিশকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ার অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্প্রতি দলের একাংশ নরেনবাবুর বিরুদ্ধে রাজ্য নেতৃত্বকে চিঠি পাঠায়। অভিযোগ, এলাকার কয়লা-বালি মাফিয়া, বোল্ডার কারবারিদের থেকে নিয়মিত টাকা নেন নরেন্দ্রবাবু। চাকরির নাম করে অনেক বেকারের থেকে টাকা নেওয়া, পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে পঞ্চায়েত সমিতি ও পঞ্চায়েতকে কাজ করাতে বাধ্য করার মতো অভিযোগও রয়েছে। তাঁর পরিবার সবক’টি অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছে। তবে তৃণমূলের বর্ধমানের নেতারা কিন্তু নরেনবাবুর ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবু বলেন, ‘‘নরেনবাবুর ব্যাপারে জেলা নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।’’