দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জের বিধায়ক মাহমুদা বেগমের সঙ্গে দলের জেলা নেতৃত্বের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মাহমুদার বিরুদ্ধে একাধিকবার স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। গত বছর তাঁর মেয়ে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পাওয়ার পরে সেই অভিযোগ আরও তীব্র হয়। সম্প্রতি প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ করেছেন দলেরই কয়েকজন নেতা। মাহমুদাও পাল্টা অভিযোগ করেছেন। তিনিও প্রকাশ্য সভায় বলেছেন, ‘‘আমি সবার পাতে ভাত দেব, আমার পাতটাই কি খালি থাকবে?’’ তাঁর দাবি, ‘‘আমার মেয়ে না হয় চাকরি পেয়েছে। ব্লকের অন্য নেতাদের আত্মীয়দেরও তো চাকরি হয়েছে। তখন তো কেউ কিছু বলছে না।’’
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই কুমারগঞ্জেই ১৬ ডিসেম্বর প্রশাসনিক সভা করতে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই নিয়েই এখন সরগরম দক্ষিণ দিনাজপুরের রাজনীতি। এক পক্ষের দাবি, দলনেত্রীর সভায় তৃণমূলের কাজিয়া কমবে। আর এক পক্ষ মনে করছে, কুমারগঞ্জ থেকে মমতা কী বার্তা দেন, তার উপরেই নির্ভর করছে জেলা তৃণমূলের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের ভবিষ্যৎ। মমতা খোলাখুলি মাহমুদার পাশে দাঁড়াবেন কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে।
তাই জেলার চারটি বিধানসভা এলাকাতেই তৃণমূলের দুই পক্ষের প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকলেও কুমারগঞ্জের পরিস্থিতি সব থেকে খারাপ বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর। সেই মাহমুদার কেন্দ্রেই মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়ার কথায় তাই দক্ষিণ দিনাজপুরে শাসক দলের দুই পক্ষের মধ্যে কাজিয়া বাড়বে না কমবে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। দলের জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্রের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কেন কোথায় সভা করবেন সেটা সম্পূর্ণই তাঁর সিদ্ধান্ত। তবে দলে কোনও কাজিয়া নেই।’’ মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তীও একই দাবি করেন।
মাহমুদা দলের মন্ত্রী শঙ্করবাবুর ঘনিষ্ঠ। সে কারণেই তাঁকে বিপ্লববাবুর অনুগামীদের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ। মাহমুদাও পাল্টা চাপ দিচ্ছেন। তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘চাকরি দেয় প্রাথমিক শিক্ষা দফতর, অথচ আমার হলে গেল দোষ। কারণ আমার মেয়েটার চাকরি হয়েছে।’’ বিধায়কের প্রশ্ন, ‘‘কই ব্লকের এক বড় নেতার মেয়ের চাকরি হল, অন্য ব্লকেরও অনেকের চাকরি হল, তা নিয়ে কেউ তো কিছু বলছেন না?’’
জেলার ৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৫টিই তৃণমূলের হাতে। এক মাত্র সাংসদও তৃণমূলের। জেলা পরিষদ শাসক দলের কব্জায়। জেলায় রয়েছে ৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ৮টি পঞ্চায়েত সমিতি। সেগুলিও সব তৃণমূলের দখলে। কিন্তু এমন প্রায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও নেতাদের মনোমালিন্যে দক্ষিণ দিনাজপুরে তৃণমূল ক্রমশ জমি হারাতে শুরু করেছে। কলেজ থেকে কিসাম মান্ডি—যে কোনও বিষয় নিয়েই দলের দুই পক্ষের বিবাদে রক্তারক্তিও ঘটছে নিয়মিত। বাসিন্দারা বিরক্ত।
সম্প্রতি বালুরঘাটেরই দু’টি কলেজে সামান্য কারণ নিয়ে মারামারি হয়ে গিয়েছে জেলা সভাপতি বিপ্লববাবু এবং মন্ত্রী শঙ্করবাবুর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে। দলের এক উপপ্রধান খুনের ঘটনায় দক্ষিণ দিনাজপুরের বিধায়ক গোষ্ঠী বনাম দলের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করেছেন। থানায় পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। বিধায়কদের নিজের নিজের এলাকার উপরে অধিকার বাড়ানোর ক্ষমতা দেওয়ার পর থেকে এই আগুনে ঘি পড়েছে। তৃণমূলের অন্দরেরই খবর, দলের সাংগঠনিক শক্তি এখনও অনেকটাই জেলা সভাপতি বিপ্লববাবুর নিয়ন্ত্রণে। দলের ছাত্র ও যুব শাখার উপরেও তাঁর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু বিধায়কদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এ বার তাঁরা নিজেদের এলাকার নেতৃত্ব ঢেলে সাজার অনুমতি পেয়ে বিপ্লববাবুর অনুগামীদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সেখানে নিজেদের লোক নিয়ে আসছেন বলে দাবি। এই নিয়েই উত্তেজনা বাড়ছে।
কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নীলাঞ্জন রায় বলেন, ‘‘এ জেলায় বিরোধীদের কোণঠাসা করে রেখেছে শাসক দল। কিন্তু শাসক দলের নিজেদের মধ্যে মারামারি ক্রমশ এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে মানুষ তৃণমূল সম্পর্কে ভীত হয়ে উঠছেন।’’