বাঁ দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
ইডি বা সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দিকে ‘রাজনৈতিক’ কাজ করে চলার অভিযোগ হামেশাই তোলে তৃণমূল-সহ দেশের বিরোধী দলগুলি। এ বার সিএজি (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া)-র দিকেও একই অভিযোগে আঙুল তুলল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। ২০০২-০৩ সাল থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত যে রিপোর্ট নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে তর্কবিতর্ক অব্যাহত, তাতে এ বার সিএজিকেও বিঁধল তৃণমূল। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের মতে, ‘বিজেপির কথাতে রাজনৈতিক ইস্যু’ তৈরি করছে সিএজি। আর তাকে হাতিয়ার করছে বিরোধীরা। বাম জমানার দায় বর্তমান সরকার নেবে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের পাল্টা খোঁচা, আর কত দিন বাম জমানা করে কাটাবে তৃণমূল! সুকান্তের দাবি, মমতার আমলে টু-জির থেকেও বড় কেলেঙ্কারি হয়েছে।
রবিবার সকালে তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে কুণাল ছাড়াও ছিলেন দলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং লোকসভার সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার। ডেরেক বলেন, ‘‘বিজেপি যুক্তরাষ্ট্রীয় আর্থিক সন্ত্রাস চালাচ্ছে বাংলার বিরুদ্ধে। কারণ তারা রাজনৈতিক ভাবেই এই রাজ্যের বিরোধী।’’ কাকলি বলেন, ‘‘গরিবদের পেটে লাথি মেরেছে মোদী সরকার। তবে বাংলায় এ সব চলবে না।’’ কেন্দ্র না-দিলে রাজ্যই ‘বঞ্চিত’ মানুষদের বকেয়া টাকা দেবে বলে মমতা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে জন্য তাঁকে প্রণামও জানিয়েছেন কাকলি। কুণালের দাবি, সিএজির এই রিপোর্ট নিয়ে কুৎসা করছে বিরোধীরা। তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছে সিএজি। কুণাল জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় অনুদান কতটা ব্যবহার হয়েছে, তার শংসাপত্র (ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট) নিয়ম মেনে কেন্দ্রের হাতে দেওয়া হয়েছে। তার পরেও সিএজি এমন কিছু কথা বলছে, যার ‘অপব্যবহার’ করছে বিরোধীরা। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সিএজি এমন কিছু কথা বলছে, এমন ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যাতে বিরোধীরা কুৎসা, অপব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।’’ এ সবের নেপথ্যে বিজেপির ইন্ধনও দেখেছেন কুণাল। তিনি বলেন, ‘‘আশা করব, সিএজি এই ধরনের কিছু বিভ্রান্তিকর লেখার থেকে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার থেকে, বিজেপির কথায় রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে দেওয়ার দলিল তৈরি থেকে বিরত থাকবে।’’
কুণাল জানান, ২০০২-০৩ সাল থেকে ওই রিপোর্ট দিয়েছে সিএজি। তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে ২০১১ সালে। তাই প্রথম ১০ বছর বাম জমানায় কী হয়েছে, তার দায় নেবে না তাঁর দল। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ দাখিল না করার অভিযোগও মানেননি কুণাল। যে সিএজি রিপোর্ট নিয়ে এত বিতর্ক, সেখানে বলা হয়েছে, এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের অডিট রিপোর্টে অর্থ খরচের শংসাপত্র জমা না দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনও উন্নতি হয়নি। উল্টে হিসাব-বহির্ভূত অর্থ খরচের পরিমাণ ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। এই অভিযোগ উড়িয়ে কুণালের দাবি, ‘‘কেন্দ্র-রাজ্য অফিসার স্তরে যখন এই বিষয়ে কথা হয়েছে, তখনও কেন্দ্রের আধিকারিকেরা ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেটের কথা বলেননি। যে অনুদান যেখানে ব্যবহার হয়েছে, তার নথি মমতার সরকার উপযুক্ত দফতরে জমা করেছে। সেখানে কোনও শংসাপত্র জমা করা পেন্ডিং নেই।’’ কুণালের প্রশ্ন, তা হলে এখন কেন সেই কথা বলছে মোদী সরকার।
তৃণমূলের এই কটাক্ষের জবাব দিয়েছেন সুকান্ত। মনে করিয়ে দিয়েছেন, রিপোর্টে যে সময়সীমা ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ১০ বছর তৃণমূলের আমলে। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল আর কত কাল বাম আমল বাম আমল করে কাটাবে। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সিএজি রিপোর্ট নিয়ে বলেছি। টু-জির থেকে বড় কেলেঙ্কারি। তার ১০ বছর আগেই বামেরা বিদায় নিয়েছে।’’ এর পরেই সুকান্ত বলেন, ‘‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। মুখ্যমন্ত্রী চুরিশ্রী পুরস্কার চালু করে নিজেকে দিয়ে দিন।’’
সিএজি রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২১-এর মার্চ মাস পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অনুদানের ১ লক্ষ ৯৪ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ খরচের শংসাপত্র জমা দিতে পারেনি। সেই রিপোর্টকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী সরকার অভিযোগ তুলেছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ২ লক্ষ ২৯ হাজার কোটি টাকা খরচের শংসাপত্র দিতে পারেনি। বিরোধীদের দাবি, রাজ্যের তৃণমূল সরকার এই টাকা নয়ছয় করেছে। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, এর মধ্যে ২০০২-০৩ থেকে বাম জমানার হিসাবও রয়েছে। তাঁর কাছে কেন ২০০৩ সালের হিসাব চাওয়া হচ্ছে? সে সময়ে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতাতে আসেনি।
রেড রোডে ধর্নার দ্বিতীয় দিনে, শনিবার ১০০ দিনের বকেয়া মজুরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা। মমতা স্পষ্ট করে দেন, কেন্দ্র টাকা দিলে ভাল, কিন্তু আর কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না তাঁর সরকার। রাজ্যে যে ২১ লক্ষ মানুষের ১০০ দিনের কাজের মজুরি বকেয়া রয়েছে, তা মেটাবে নবান্নই। মমতা বলেন, ‘‘২১ লক্ষ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ২১ ফেব্রুয়ারি বকেয়া মজুরির টাকা পৌঁছে যাবে।’’ রবিবার সাংবাদিক সম্মেলনে মমতার এই ঘোষণাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেছেন ডেরেক।