অন্ধকার এক্সপ্রেসওয়ে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি। তদন্তে নেমে পুলিশ বেশ কিছু সূত্র পেলেও বেলঘরিয়ার জুনিয়র মৃধা অথবা হুগলির সুপ্তেন্দু দত্তর খুনের কিনারা হয়নি এখনও।
বেলঘরিয়া বা কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে গত পাঁচ মাসে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ ছিনতাই, খুন ও লুঠপাটেরই কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। মাঝেমধ্যেই খবর মেলে এই দুই এক্সপ্রেসওয়ের ধারে পড়ে আছে অজ্ঞাতপরিচয়ের দেহ। দুর্ঘটনা না খুন, তার কিনারা হয় না। কখনও খোঁজ পেয়ে মর্গ থেকে দেহ নিয়ে যায় পরিবার। কখনও বা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে সৎকার হয়ে যায়।
বিমানবন্দরের ১ নম্বর গেট থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের ৯ কিলোমিটার অংশে কয়েক হাজার বাতিস্তম্ভ থেকে চুরি গিয়েছে দামি মার্কারি ল্যাম্প, তার, অটোমেটিক স্যুইচ কন্ট্রোল মেশিন। দুই লেনের চওড়া রাস্তায় অন্ধারের সুযোগে দাপট বেড়েছে বাইকবাহিনী ও ছিনতাইবাজদের। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে আলোর ব্যবস্থা কোনও দিনই ছিল না। এখনও একটিই লেন। দু’ধারে পানশালা ও দেহব্যবসার রমরমা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে নেশার ঠেক। অথচ আরএফএস (রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড)-এর মতো অত্যাধুনিক টহলদারি গাড়িতে পুলিশ নজরদারি করছে দিন-রাত!
শুধু এক্সপ্রেসওয়েই বা কেন? সোদপুরে ভরসন্ধ্যায় দুষ্কৃতীরা উড়ালপুলের উপর থেকে ভরা বাজারে বোমা ছোড়ে। টিটাগড়ে মণ্ডলুয়ার মতো ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ দুষ্কৃতী থানার পিছনেই বোমা ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায় সদলে। এ শহরে বাড়িতে ঢুকে ডাকাতেরা গৃহকর্ত্রীর থেকে চা চেয়ে খায়। তার পরে টাকা-গয়না কেড়ে গৃহকর্তাকে বাড়ির গাড়িটাও বার করে দিতে বলে। যাতে চেপে তারা নিশ্চিন্তে পালিয়ে যেতে পারে। নিমতা নদীকূলে ব্যস্ত রাস্তার ধারে বাড়িতে ঢুকে ক্যামেরা, ডিভিডি-সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র
নিয়ে চোরের দল পায়ে হেঁটে চলে গেলেও পুলিশ তার নাগাল পায় না। যেমনটা হয় প্রাতর্ভ্রমণে বেরোনো মহিলাদের গলা থেকে হার ছিনতাইয়ের পরেও।
গত তিন বছরে রাজ্য সরকারের যে সমস্ত পদক্ষেপ শিল্পাঞ্চলের সৌন্দর্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিল এলাকাবাসীকে, তার অন্যতম ছিল গঙ্গার ঘাট বাঁধানো এবং খেলার মাঠ-পার্কগুলোতে আলো লাগানো। সেই সাজানো উদ্যান এবং ঘাটে সন্ধ্যার পরে অবশ্য বসতে সাহস পান না অনেকেই। এলইডি-র ঝকঝকে আলোতেও নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকে গিয়েছে সেই তিমিরেই। সম্প্রতি পানিহাটিতে খেলার মাঠে নেশা করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভরদুপুরে রক্তাক্ত হতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
জগদ্দলের হাঁসিয়ার কাছে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে পেট্রোল পাম্প তাপস চক্রবর্তীর। কিছুদিন আগেই সেখানে হানা দেয় মোটরবাইক-আরোহী দুষ্কৃতীরা। তাপসবাবু বলেন, ‘‘আগেও এক্সপ্রেসওয়েতে লুঠপাট চলত। এখন আরও বেড়ে গিয়েছে। পুলিশের তোয়াক্কা না করে অন্ধকারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলন্ত মোটরবাইক থেকে হার ছিনতাই করছে কুড়ি-একুশ বছরের ছেলেরা। মুখ খোলা, হাতে ওয়ান শটার। পাম্পে ঢুকে গুলি চালিয়ে ওরা টাকা লুঠ করে পালিয়ে গেলেও কিছু করার থাকবে না।’’ ইতিমধ্যেই এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া অধিকাংশ পাম্পেই রাতে মোটরবাইকে তেল দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। টাটা সুমো বা মারুতি ভ্যান জাতীয় গাড়িতেও তেল ভরতে চান না কর্মীরা। পাম্প মালিকেরা জানান, দুষ্কৃতীরা মূলত এই ধরনের যানবাহনই ব্যবহার করে। তাই আত্মরক্ষার্থেই এই ব্যবস্থা।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ থেকে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট— আশা আর প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তিন বছর পরে?
বড় বড় মোড়ে রাত ১০টা পর্যন্ত পুলিশ, সিসিটিভি ক্যামেরা, বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান। আগেকার মতো এক জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বদলে এখন নিরাপত্তার ভার নিয়েছেন আইজি পদের আধিকারিক। সুপার পদমর্যাদার অফিসার কমিশনারেটে চার জন। নীল বাতি লাগানো গাড়ি, কোমরে নাইন এমএম পিস্তল গোঁজা উর্দিধারী এখন গোটা শিল্পাঞ্চলেই যখন-তখন চোখে পড়ে। তবু এই শিল্পাঞ্চলেই গত পাঁচ মাসে নারী-নির্যাতনের অভিযোগ ৭২৫টি। চুরির অভিযোগ, ৬৩০টি। খুন ৩২টি। ডাকাতি ৭টি। ২০১২ সালে কমিশনারেট হওয়ার পরে ব্যারাকপুরে নারী-নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী ১৩০০টি, ২০১৩ সালে ১৫০০, ২০১৪ সালে ১৭১৫টি। ২০১২তে খুনের মামলা ৭০টি, ২০১৩ সালে ৮৭টি, ২০১৪ সালে ৯৬টি। এই শিল্পাঞ্চলে সবথেকে বেশি বার পুলিশ কমিশনার বদলেছে অপরাধের সংখ্যা বাড়া এবং কিনারা করতে না পারার অভিযোগে।
চতুর্থ পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহের অবশ্য দাবি, ‘‘কমিশনারেট এখন অনেক শান্ত। অপরাধ কমছে। অধিকাংশ তদন্তের কিনারা হচ্ছে।’’ অথচ সেই দাবি আড়ালে উড়িয়ে দিচ্ছেন নিচুতলার আধিকারিকরাই।
ব্যারাকপুরে পুলিশি নিরাপত্তা যে খুব বেশি মাত্রায় শিথিল হয়ে গিয়েছে, তা বলছেন বিরোধী নেতারাও। গত তিন-চার মাসে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের নিরাপত্তা নিয়ে অসংখ্য প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলন, ঘেরাও, বিক্ষোভ, পথসভা হয়েছে। অবস্থা পাল্টায়নি তাতে। সপ্তাহ তিনেক আগে পুলিশের ‘এনকাউন্টারে’ ব্যারাকপুরে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই তখন এক সুরে পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করে। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘‘পুলিশ কমিশনার এই শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। অপরাধ মাত্রাছাড়া। কিন্তু কোথায় তদন্তের কিনারা হচ্ছে? আর যদি নজরদারই থাকবে তবে অপরাধই বা বাড়ছে কেন এত?’’ শিল্পাঞ্চলের সিপিএম নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘তৃণমূল আর কমিশনারেটের পুলিশ মিলেমিশে গিয়েছে। তাই কমিশনার যেমন নিজের চোখ-কান ছাড়া অধস্তনদের উপর ভরসা করতে পারেন না, তেমনই শাসক দলের চোখ-কান হয়েই উনি কাজ করছেন। এ ভাবে চাকরি বাঁচানো যায়, কিন্তু সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।’’ আর কংগ্রেসের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তাপস মজুমদার বলেন, ‘‘নিজেকে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহভাজন আর ক্ষমতাবান মনে করলেও পুলিশ কমিশনার ভুলে যাচ্ছেন মানুষ সব দেখছে। উনি কাউকে পরোয়া করেন না, দেখা করেন না, কথা বলেন না। অথচ সাধারণের নিরাপত্তার জন্যই ওই পদে তিনি বসে আছেন। পরপর অপরাধ হয়েই চলেছে। কমিশনারের পরিবর্তন না হলে নিরাপত্তার আরও বেহাল দশা হবে।’’
উত্তর ২৪ পরগনা তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘সম্প্রতি এক প্রশাসনিক বৈঠকে নিরাপত্তা নিয়ে ব্যারাকপুর কমিশনারেট তথা প্রশাসনকে কড়া হতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে দলমত নির্বিশেষে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।’’