এই ট্রলি ব্যাগেই সুচেতা চক্রবর্তীর দেহাংশ মিলেছিল।—ফাইল চিত্র।
ব্যবধান আড়াই বছরের। কিন্তু, ঘটনাস্থল এক। এবং ফের খুনে অভিযুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।
বৃহস্পতিবার সকালে দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে বাঁকুড়ার যুবতী শিল্পা অগ্রবালের ব্যাগ-বন্দি দেহ উদ্ধারের ঘটনা উস্কে দিয়েছে আড়াই বছর আগের স্মৃতি। সুচেতা চক্রবর্তী এবং তাঁর শিশুকন্যা দীপাঞ্জনা খুনের স্মৃতি! যে ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল সবাইকে।
দুর্গাপুর শহরের বিধাননগর আবাসনে থাকতেন সুচেতা। অভিযোগ, তাঁকে ও তাঁর একরত্তি মেয়েকে খুন করে দেহ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরে ২০১৫ সালের ২৯ অগস্ট ব্যারাকপুর থেকে শেওড়াফুলির মাঝে গঙ্গায় ভুটভুটি থেকে ফেলে দেন দুর্গাপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার (এখন সাসপেন্ডেড) সমরেশ সরকার। সুচেতা বিবাহিত হলেও বিধাননগরে বাপের বাড়িতে থাকতেন মেয়েকে নিয়ে। সমরেশেরও সংসার রয়েছে। তাঁর ব্যাঙ্কেরই গ্রাহক ছিলেন সুচেতা। তদন্তে জানা যায়, দু’জনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের জন্য চাপ দেওয়াতেই প্রেমিকা ও তাঁর মেয়েকে সমরেশ খুন করেন বলে অভিযোগ।
শ্রীরামপুর থানার পুলিশ খুন ও প্রমাণ লোপের ধারায় মামলা রুজু করে। ঘটনার তিন মাসের মধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। শ্রীরামপুর আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের এজলাসে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় পনেরো জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে বলে সূত্রের খবর। ধরা পড়া ইস্তক জামিন পাননি সমরেশ। তাঁর ‘কাস্টডি ট্রায়াল’ চলছে।
তাই সেই দুর্গাপুরেই শিল্পার খুনের কথা জেনে স্তম্ভিত সুচেতার নিকটজনেরা। সুচেতার স্বামী শ্রুতিধর মুখোপাধ্যায় স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক। তাঁর কথায়, ‘‘বিস্মিত হচ্ছি। মানুষ কতটা নেমে গেলে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে!’’ তিনি জানান, ওখানে সুচেতার প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। ফোনে খেজুরে আলাপ করলেও একটা লোক যে সুচেতার ঘরে যাতায়াত করত, ঘুণাক্ষরেও কেউ বলেননি আমাকে। ‘‘অথচ ঘটনার পরে শুনি, পুলিশকে তাঁরা বলেছেন সুচেতার ঘরে সমরেশের যাতায়াতের কথা তাঁরা জানতেন।’’—প্রতিক্রিয়া শ্রুতিধরের। সুচেতার মামা প্রভাত পাঠকের বক্তব্য, ‘‘ওই ঘটনা এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাদের। যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার। উদাহরণ তৈরি না হলে বিকৃত মানসিকতার লোকগুলো ভাববে, অসহায় মেয়েদের উপর এমন করেও দিব্যি পার পাওয়া যায়। তাতে কারও সংসার শেষ হবে। প্রিয়জনকে হারাতে হবে।’’
সুচেতা যেখানে থাকতেন, বিধাননগরের সেই আর-৩ ব্লকের বাসিন্দারাও শিউরে উঠেছেন শিল্পা-খুনের ঘটনার কথা জেনে। তাঁরা আরও বিস্মিত, ফের এক ব্যাঙ্ক-ম্যানেজারের নাম জড়ানোয়। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সুচেতার বাড়ি এখনও তালাবন্ধ অবস্থায় রয়েছে। আগাছায় ভরেছে আবাসনের আশপাশ।
এলাকার বেশ কয়েক জন বাসিন্দা জানান, সুচেতার খুনের সময় তাঁরা ভেবেছিলেন, এমন নৃশংস মানুষ কী করে হতে পারে। ধীরে ধীরে সেই ঘটনা মুছে যাচ্ছিল মন থেকে। কিন্তু, বৃহস্পতিবারের ঘটনা ফের তাঁদের নাড়িয়ে দিয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, মূল অভিযুক্ত সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দা মহিলা তনুশ্রী মণ্ডল, সাবিত্রী দাস বলছিলেন, ‘‘এ দিন সকালে টিভির পর্দায় খবরটা দেখেই আবার সুচেতা, দীপাঞ্জনার খুনের কথা মনে পড়ে যায়।’’ কথা বলতে বলতে চোখে জলও চলে আসে কয়েক জনের। তাঁরা বলেন, ‘‘বিশেষ করে দীপাঞ্জনার মুখটা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। ওর তো কোনও দোষ ছিল না।’’
স্ত্রী-মেয়েকে হারিয়ে শ্রুতিধরের ভরসা এখন আদালত। তাঁর কথায়, ‘‘বিচারব্যবস্থার উপরেই ভরসা রাখছি। আর কোথায়ই বা রাখব!’’