বিজেপির তরফে প্রথমে পুলিশ কমিশনারের কাছে ক্ষমা চেয়ে লেখা হয় এই চিঠি (বাঁ দিকে)। পরে দলের পক্ষে দুঃখপ্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমকেও বিবৃতি দেওয়া হয় (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র
পুলিশের জনসংযোগ কর্মসূচিকে দলীয় অনুষ্ঠান বলে প্রচার করার অভিযোগ উঠল বিজেপির দার্জিলিং জেলার তথ্য প্রযুক্তি সেলের আহ্বায়ক অর্জিত দত্ত জোয়ারদারের বিরুদ্ধে। অর্জিতবাবুর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলাও রুজু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে শিলিগুড়ির প্রধানগরের কুলিপাড়ায় পুলিশের ওই অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু, বিজেপির তরফে মোবাইলের ‘হোয়াটসঅ্যাপে’ প্রচার করা হয়, তাদের ওয়ার্ড কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত প্রশ্নোত্তরে যোগ দিতে রাজি হয়েছেন পুলিশ কমিশনার সহ ৩ জন অফিসার। সেই খবর পৌঁছয় নবান্নে। মুর্শিদাবাদ সফরে রওনা হওয়ার আগে বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানতে পারেন। নবান্ন থেকে বিষয়টি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মাকে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে বিকেলে থানার আইসি তপন ভট্টাচার্য অর্জিতবাবুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘শিলিগুড়ি পুলিশের জনসংযোগ অনুষ্ঠান ছিল। আমরাই তার আয়োজন করি। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের কোনও সম্পর্ক নেই। বিষয়টি নিয়ে বিশদে তদন্ত হচ্ছে।’’
তবে বিজেপির দার্জিলিং জেলা কমিটির পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করে একাধিক বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় অর্জিতবাবু প্রথমে পুলিশ কমিশনারকে চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েছেন। পরে বিজেপির দার্জিলিং জেলা সভাপতি রথীন বসু দলীয় প্যাডে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেন। রথীনবাবু জানান, ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিজেপির। পুলিশের অনুষ্ঠানে তাঁদের দলের অনেকেই গিয়েওছিলেন। নানা ভাবে সহযোগিতাও করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা দলের তরফে ওই অনুষ্ঠানের প্রচার করি। কিন্তু ভুলবশত তা ওয়ার্ড কমিটির কর্মসূচি বলে লেখা হয়েছিল। সে জন্য একাধিকবার ক্ষমা চাওয়ার পরেও কেন মামলা হল, বুঝতে পারছি না।’’
শুধু তা-ই নয়, প্রধাননগর থানার পুলিশ অফিসারদের একাংশের অনুরোধেই বিজেপির ওয়ার্ড কমিটির নেতারা যে ওই উদ্যোগে সামিল হয়েছিলেন, সেই দাবিও করেছেন বিজেপির জেলা সভাপতি। বিজেপির কয়েকজন নেতার দাবি, ওই অনুষ্ঠানের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ কমিশনারের পাশে থেকে পরিচালনায় সহায়তা করেছিলেন বিজেপির ১ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি সরিস যাদব ও যুব নেতা কানাইয়া পাঠক। প্রয়োজনে আদালতে ভিডিও ফুটেজ পেশ করা হবে বলে বিজেপির কয়েকজন নেতা-কর্মী জানিয়েছেন।
ঠিক কী হয়েছিল? প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জনতার কাছে পৌঁছতে জনসংযোগ কর্মসূচিতে নেমেছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে শিবির করে জনতার অভিযোগ নথিভুক্ত করছেন। তেমনই শহরের কেন্দ্রস্থলের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুলিপাড়ায় এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় জনসংযোগ শিবিরের আয়োজন করে পুলিশ। পুরভোটে ওই ওয়ার্ডে এবার বিজেপি জিতেছে। আমজনতা ও অন্য দলের কর্মী-সমর্থকেরা থাকলেও শিবিরের পুরো ভাগে দেখা যায় বিজেপির কাউন্সিলর মালতি রায়কে। স্থানীয় বিজেপি নেতা-কর্মীরা অনেকে শিবিরে হাজির হয়ে প্রশ্নও করেন। পুলিশ কমিশনার উত্তরও দেন।
কিন্তু, অনুষ্ঠান শুরুর প্রাক্কালে বিজেপির তথ্য প্রযুক্তি সেলের আহ্বায়ক হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়ে দেন, তাঁদের ১ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি একটি ‘সওয়াল-জবাব’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেখানে পুলিশ কমিশনার সহ কয়েকজন অফিসার হাজির থাকবেন। সেই প্রচারের খবর পৌঁছে যায় নবান্নে। সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্যের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করতেই নড়েচড়ে বসেন শিলিগুড়ি পুলিশ কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে খবর পান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব, শিলিগুড়ির বিধায়ক তৃণমূলের রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। দুজনে আলাদা ভাবে জানান, জনসংযোগ কর্মসূচির ব্যাপারে পুলিশ তাঁদের কিছু জানায়নি। মন্ত্রী বলেন, ‘আমি ঘটনাটি শুনেছি। পুলিশ-প্রশাসনের যা করণীয় করবে।’’ রুদ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘কী ভাবে পুলিশের মঞ্চকে বিজেপি ব্যবহার করল, তা নিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলব।’’
মালতীদেবী জানান, দলের পক্ষ থেকেই তাঁকে অনুষ্ঠানে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘‘আমি সকালে কিছু ক্ষণ ছিলাম। অনুষ্ঠানটি পুলিশের অনুষ্ঠান বলেই জানি। এর বেশি আমার জানা নেই।’’ দার্জিলিং জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যও পুর এলাকায় এমন কর্মসূচি হচ্ছে তা জানতেন না। তিনি বলেন, ‘‘এই প্রবণতা শাসক দল, বিজেপি সবার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সংবিধান বা আইন কেউ মানছে না। না হলে পুলিশের অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে বিজেপি প্রচার করে?’’