ছবি পিটিআই।
সাতাশ বছর পর ব্যাপক হারে উত্তর-পশ্চিম ভারতে হানা দিয়েছে পঙ্গপালের দল। বাংলার চাষিদের মধ্যেও আশঙ্কা, এ রাজ্যেও কি চলে আসতে পারে পঙ্গপাল? বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন কৃষি দফতরের পতঙ্গবিদ এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের কর্তারা। কেন্দ্রীয় পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে রাজ্যের কৃষি কর্তাদের। তাঁরা জানাচ্ছেন, রাজ্যে পঙ্গপালের হানার আশঙ্কা এখনই নেই। তবে উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশে আসার পর পঙ্গপালের দল যদি খাবার না পায় এবং রাজ্যে বর্ষা ঢুকতে দেরি হয়, তা হলে তারা বাংলার পথ ধরতে পারে। তবে তার আগেই পঙ্গপালের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা যাবে বলে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের কর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের অধীন ‘লোকাস্ট ওয়ার্নিং অর্গানাইজেশন’ দেশ জুড়ে পঙ্গপাল হানার উপরে নজরজারি করে। সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টর (প্ল্যান্ট প্রোটেকশন) কে এল গুর্জর আনন্দবাজারকে বলেন, ‘’এই মুহূর্তে যে ভাবে হাওয়া বইছে, তাতে পঙ্গপালের পশ্চিমবঙ্গে বা পূর্ব ভারতে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, হাওয়া সে দিকে বইছে না। বাংলায় গত তিন-চার দশকে পঙ্গপাল হানা দেয়নি।‘’
রাজ্যের কৃষি দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, আর দু’সপ্তাহের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ঢুকে পড়বে। ফলে পঙ্গপালের দল উল্টো হাওয়ার তাড়া খেয়ে ফের থর মরুভূমিতে ফিরতে শুরু করবে। বাংলার মাঠে এখন কোনও ফসলও নেই। রবিশস্য উঠে গিয়েছে। আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মরসুমি আনাজ। ফলে মাঠে খাবার না থাকায় পঙ্গপাল বঙ্গমুখী হবে না বলেই মনে করছেন কৃষি কর্তারা। পঙ্গপালের ঝাঁক এখন রাজস্থান থেকে মধ্যপ্রদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মহারাষ্ট্রে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হাওয়া ঢুকছে বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে। উত্তরবঙ্গের দিক থেকে উত্তরপ্রদেশ হয়ে দিল্লির দিকে হাওয়া বইছে। ফলে পঙ্গপাল-ঝাঁকের দিল্লিতে পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কাও নেই বলে গুর্জরের দাবি।
পঙ্গপাল-বৃত্তান্ত
• শুঁড়ওলা ফড়িং জাতীয় প্রাণী। অনেক ধরনের হয়। যেমন, মাইগ্রেটরি লোকাস্ট (লোকাস্টা মাইগ্রেটোরিয়া), ডেজ়ার্ট লোকাস্ট (শ্চিসটোসেরসা গ্রেগরিয়া), গার্ডেন লোকাস্ট (অ্যাকানথাক্রিস রুফিকরনিস)
• সাধারণত এরা একাই থাকে। তখন একেবারেই নিরীহ
• কিন্তু অনেক সময়ে (খরার পর প্রচুর ফলন) এরা সংখ্যায় বেড়ে যায়। তখন দল বেঁধে থাকে
• পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া ‘সেরোটোনিন’ নামে নিউরোট্রান্সমিটার পতঙ্গের স্বভাব বদলায়। ব্যাপক হারে প্রজনন ঝাঁকে ঝাঁকে অন্যত্র পাড়ি
• তিন মাসে দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ২০ গুণ হতে পারে। একটি পঙ্গপাল ১০০টি সন্তানের জন্ম দিতে পারে
• একটি ঝাঁক ১ দিনে ১৫০ কিমি পর্যন্ত যেতে পারে
• কয়েকশো বর্গকিলোমিটার জুড়ে হামলা করতে পারে পঙ্গপালের একটি ঝাঁক। এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৮ কোটি পূর্ণবয়স্ক পঙ্গপাল থাকে। এক দিনে ৩৫,০০০ লোকের খাবার খেয়ে নিতে পারে
• সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ভারতে পঙ্গপালের উপদ্রব হয়
• ১৯৬১ সালে কলকাতায় হামলা
এ দেশে বড় আকারে পঙ্গপালের হানা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। বাংলায় ১৯৬১ সালে পঙ্গপাল হানার কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। সরকারি প্রামাণ্য নথি সে ভাবে নেই বলে জানাচ্ছেন কৃষিকর্তারা। তবে রবি ঠাকুরের সহজপাঠে পঙ্গপাল-হানার উল্লেখও তাঁরা মনে করাচ্ছেন।
১৯৬১-র ২৫ জানুয়ারির আনন্দবাজার পত্রিকায় পঙ্গপাল সংবাদ।
পঙ্গপালের যে দলটি ভারতে ঢুকেছে, সেটি পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, ইথিয়োপিয়ার মতো দেশ থেকে রওনা দিয়েছে। লোহিত সাগর পেরিয়ে ইরানের মরুভূমি থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে পৌঁছেছে রাজস্থানের থর মরুভূমিতে। কৃষি মন্ত্রক জানাচ্ছে, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মরু অঞ্চলে বৃষ্টির কারণে এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করেছে। তারপর খাবারের খোঁজে জনপদে ধেয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন: পঙ্গপাল মারতে ১০০০ ‘জলকামান’! যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসরে নামছে কেন্দ্র
কৃষি কর্তারা জানাচ্ছেন, পঙ্গপাল মরু অঞ্চলের শুকনো আবহাওয়া পছন্দ করে। কিন্তু ডিম পাড়ে ভিজে বাতাসযুক্ত আবহাওয়ায়। গত বছর শীতের বৃষ্টির পর থর মরুতেও তারা ব্যাপক বংশবৃদ্ধি করেছে। দু’মাস পর ‘সদ্য তরুণ’ গোলাপি পঙ্গপাল পশ্চিমা বাতাসের ধাক্কায় রাজস্থান, পঞ্জাব, গুজরাত এবং উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশে ঢুকেছে। এর পর যত বয়স হবে, এদের রঙ হলুদ হয়ে যাবে। পূর্ণবয়স্ক হলেই এরা ফের বংশবৃদ্ধি করতে চাইবে। কিন্তু তার জন্য মরু অঞ্চলের ভিজে আবহাওয়া জরুরি। ফলে সে সময় পঙ্গপাল মরু অঞ্চলে ফিরে যেতে শুরু করবে।
আরও পড়ুন: কোটি কোটি পঙ্গপালে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ, কতটা বিপদের হতে পারে
এক কৃষি কর্তার বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক ও আক্রান্ত রাজ্যগুলি একযোগে রাসায়নিক ছড়িয়ে পঙ্গপাল নিধনে নেমেছে। তার ফলে পূর্ব ভারতে পৌঁছনোর আগেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা সম্ভব হবে।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় ভল্লা রাজ্যের মুখ্যসচিবদের চিঠি লিখে বলেছেন, লকডাউন চললেও পঙ্গপাল দমনের সঙ্গে যুক্ত কৃষি কর্তা ও কর্মীদের যেন সহযোগিতা করা হয়। রাজ্যের সীমানায় তাঁদের যেন আটকে না দেওয়া হয়।