জঙ্গি সন্দেহে ধৃত লিউইয়ন আহমেদ এবং নাজমুস সাকিব।
দু’বাড়ির মাঝে দেড় কিলোমিটার ফারাক।
পুরনো বিডিও মোড়ের বাঁকে মাটির উপরে ইট গাঁথা ছাপোষা যে বাড়িটার উঠোন জুড়ে আলো-পাখা-ইলেকট্রিক ইস্ত্রি সারিয়ে দেওয়ার নিত্য আবদার নিয়ে সকাল থেকে গমগম করত, সে বাড়ির উঠোন জুড়ে এক বৃদ্ধার বিনবিনে কান্নার সুর। আর গঙ্গাদাসপাড়ার পাকাপোক্ত বাড়িটার চৌহদ্দি জুড়ে পাড়ার ছেলে-বুড়োর থিকথিকে ভিড়।
শুক্রবার বিকেলেও এ-বাড়ি ও-বাড়ির চলাচল ছিল অনায়াস। বসন্তপুর কলেজের অস্থায়ী কর্মী লিউইয়ন আহমেদের সাইকেলের ক্যারিয়ারে দু’পা ঝুলিয়ে টোটো করে ঘুরছে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সের দ্বিতীয় সিমেস্টারের ছাত্র নাজমুস সাকিব— এ ছবি দেখতেই অভ্যস্ত ছিল পড়শি দুই গ্রামের মানুষজন। শুক্রবার রাতে এনআইএ তাদের দু’জনকেই গ্রেফতার করায় সেই চেনা ছবিটা হঠাৎ যেন হারিয়ে গিয়েছে।
জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সন্দেহে মুর্শিদাবাদের যে ৯ যুবককে ডোমকল-জলঙ্গি-রানিনগর এবং কেরলের এর্নাকুলাম থেকে গ্রেফতার করেছে এনআইএ, তাদের অধিকাংশই স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই পড়াশোনায় ইতি টেনে দিয়েছিল। ব্যতিক্রম শুধু লিউইয়ন আর নাজমুস। লিউইয়ন এমএ পাশ। ডোমকল বসন্তপুর কলেজের পরিচিত অস্থায়ী কর্মীই শুধু নয়, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হিসেবে এলাকায় তার পরিচিতি বেশ ছড়ানো। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া নাজমুসের সঙ্গে তার সখ্যও ওই পড়াশোনার সূত্রেই বলে এত দিন পাড়া-পড়শি জেনে এসেছেন। গ্রামের এক বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘ওদের বন্ধুত্বের আর কোনও কারণ থাকতে পারে, কোনও দিন তো ভেবে দেখিনি!’’
লিউইয়ন বসন্তপুর কলেজে, কেয়ারটেকারের দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি কখনও যে ক্লাস নিতেন, জানাচ্ছেন কলেজ কর্তৃপক্ষও। তাদের আড্ডায় নাক গলিয়ে পড়াশোনার বাইরে খুব কিছু শুনেছেন বলেও মনে করতে পারছেন না নাজমুসের এক সহপাঠী। বলছেন, ‘‘লিউইয়ন’দার সঙ্গে কলেজ আর পড়াশোনা নিয়েই তো হরদম আলোচনা হত নাজমুসের। কত বার বলেছি, ‘‘হ্যাঁরে তোদের আর কোনও কথা নেই!’’ তার আর এক বন্ধু বলছেন, ‘‘লিউইয়ন আর নাজমুস, অসমবয়সি দু’জনের ভাল বন্ধুত্ব অবশ্য কাউকে অবাক করেনি। দু’জনেই পড়াশোনা ভালবাসে। তাই দু’জনের এত ভাব, তাই তো জানতাম।’’
পুরনো, প্রায় ভেঙে পড়া লিউইয়নের বাড়িটা যে পৈতৃক, জানাচ্ছেন পড়শিরা। মা মালা বেওয়া পুরু কাচের চশমা মুছে বলেন, ‘‘এমন ভাঙা বাড়ি সারানোর কথা বললেই ছেলে বলত, ‘দাঁড়াও মা, দুটো পয়সা জমাই তার পর মেরামত’। দিনভর এটা ওটা সারিয়ে বাড়তি দু’পয়সা আয় করত। এর বাইরে কোনও কাজ তো ওকে করতে দেখিনি!’’
প্রতিবেশীরাও জানাচ্ছেন, লিউইয়নের জীর্ণ খাটের নীচ থেকে খান কয়েক ভাঙা পাখার ব্লেড ছাড়া এনআইএ আর কিছুই নিয়ে যায়নি। এক পড়শির কথায়, ‘‘আমার পাখাটাই তো কত বার সারিয়ে দিয়েছে লিউইয়ন। খুব কাজের ছেলে ছিল।’’ নাজমুসের এক প্রতিবেশীও জানান, ওই পড়ুয়াদের বাড়ির আলো-পাখাও লিউইয়ন সারাত। এই সহজ সম্পর্কের বাইরে যে অন্য কোনও ‘সংযোগ’ ছিল ভাবতেই চাইছে না ডোমকল।
আরও পড়ুন: ডার্ক ওয়েবে বিনিময় বার্তা, চাঁই পাকিস্তানে