চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমান। —নিজস্ব চিত্র।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সে দিন (১৭ জুন) দুর্ঘটনায় পড়েছে। রাতে শিলিগুড়ি পৌঁছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে উদ্ধারকাজ এবং তদারকি নিয়ে কথা বলেছেন প্রশাসনের সঙ্গে, তখন ডাক পাননি তৃণমূলের শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি শহরের প্রথম সারির কোনও নেতা-নেত্রী। মেডিক্যাল কলেজে শুধু এক বিধায়কের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন দলনেত্রী। তিনি চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমান।
‘‘হবে না কেন?’’ বলছেন রাজ্য তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতা। তাঁর বিশ্লেষণ, ‘‘গোটা দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে চোপড়াই একমাত্র বিধানসভা, যেখানে লোকসভা ভোটে দল ৯২ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়েছিল। কদর কি এমনি বাড়ে!’’ দল সূত্রের খবর, চোপড়া থেকে তৃণমূল প্রার্থীকে বিপুল ভোটে এগিয়ে দেওয়ায় হামিদুলকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া যায় কি না, সে কথাও আলোচনায় এসেছিল। বাদ সাধল চোপড়া-কাণ্ড। ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত তাজিমুল ইসলাম ওরফে জেসিবি দলের অন্দরে বিধায়ক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তার ‘অত্যাচারের’ ভিডিয়ো (আনন্দবাজার সত্যতা যাচাই করেনি) সমাজমাধ্যমে ছড়াতে শুরু হল তোলপাড়। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে প্রকাশ্যে সাজা দেওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে বিতর্ক আরও পাকিয়ে তোলেন হামিদুল। দল তাঁকে এর মধ্যে ‘শো কজ়’ করেছে। বিধায়ক জবাব দিয়েছেন। ফল অজানা।
“চোপড়া এলাকায় সবাই জানে, কার নির্দেশে চলে এলাকার দুষ্কৃতীরা,” অভিযোগ বিরোধীদের। এমনকি তৃণমূলেরই একটি সূত্রের দাবি, চোপড়ায় অন্তত ১০টি দল রয়েছে বিধায়কের ‘অনুগামীদের’। যুগলকে প্রকাশ্যে মারধরের এলাকা লক্ষ্মীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে নেতৃত্বে জেসিবির বাহিনী। সুজালি, চুটিয়াখোর, মাঝিয়ালি, ঘিন্নিগাঁও, দাসপাড়া, চোপড়া, হাপতিয়া, সোনাপুর, গোবিন্দপুরে আলাদা দলের আলাদা প্রধান।
বিরোধীদের অভিযোগ, অবৈধ বালি খাদানের ব্যবসা এবং চা বাগানের জমি বিক্রির অবৈধ কারবারে যে টাকা ওঠে, তার প্রায় ৪০ শতাংশ ‘যায়’ বিধায়কের কাছে। বাকি অংশ চার ভাগ করে ‘বাঁটোয়ারা’ হয় এলাকার দুষ্কৃতী-দল, রাজ্য প্রশাসনের উঁচুতলা, পুলিশ এবং ভূমি সংস্কার দফতরে। এই কারবারের দৌলতে বিধায়ক ‘ফুলে-ফেঁপে’ উঠেছেন বলেও কটাক্ষ বিরোধী নেতাদের। বিধায়ক অবশ্য বলেন, ‘‘বিরোধীরা মনগড়া কথা বলে। প্রমাণ করে দেখাক। প্রমাণ করুক চা বাগানের জমি কেনা-বেচা হয়েছে। রেজিস্ট্রি হয়েছে। তা ছাড়া, ঘাটের লিজ় যার, এখানে সে-ই বালি তোলে।’’
ব্লক কংগ্রেস সভাপতি মহম্মদ মসিরুদ্দিনের পাল্টা দাবি, ‘‘সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের ছাড় দিয়ে এলাকায় ত্রাস তৈরি করেছেন বিধায়ক। বিধায়কের এই অনুগামীদের ভয়ে ২০২৩ সালেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীরা এলাকায় প্রার্থী দিতে পারেনি। এ বার লোকসভা নির্বাচনে দুষ্কৃতীদের হুমকিতে বহু বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি বিরোধীরা। সেগুলিও তা হলে মনগড়া কথা বলেই ধরতে হয়।’’ সহমত সিপিএমের উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদক আনোয়ারুল হক।
এক ধাপ এগিয়ে রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি চোপড়ায় এসে অভিযোগ করেছেন, হামিদুল রহমান সমান্তরাল প্রশাসন চালান। পুলিশ-প্রশাসনের নিচুতলা তো বটেই, উঁচুতলারও একাংশ তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে শুভেন্দুর দাবি।
সমাজমাধ্যমে ছড়ানো জেসিবির ভিডিয়ো (আনন্দবাজার সত্যতা যাচাই করেনি) ‘চাপে’ ফেলেছে। হামিদুল এখন বলেছেন, ‘‘যা ঘটেছে, ভাল হয়নি। দলের কাছে শো-কজ়ের উত্তর দিয়েছি। দল যা ভাল মনে করবে, সেটাই হবে।’’ বলছেন বটে, কিন্তু কপালের ভাঁজ মিলোচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা বলছেন, ‘‘দুশ্চিন্তা কাটবে কী করে? বলা যায় না, আবার কবে, কোন কীর্তির ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে!’’