সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
উপরাষ্ট্রপতি ভবনে বসে পশ্চিবঙ্গ বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাজ্যপালের ভাষণ শুনলেন এবং দেখলেন কি জগদীপ ধনখড়?
বুধবারের ছবি আবার বুঝিয়ে দিল, যাহা ২২, তাহা ২৩ নয়। ক্যালেন্ডারের হিসাবে ফারাক ১১ মাসের। কিন্তু দৃশ্যগত ফারাক কয়েক যোজনের। ২০২২ সালে ৭ মার্চ বাজেট বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। বেনজির ঘটনার সাক্ষী থেকেছিল রাজ্য বিধানসভা। বিক্ষোভ দেখানোর দায়ে বিজেপির দুই বিধায়ককে সাসপেন্ড করেছিলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিন বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে ‘অপছন্দ’-এর ভাষণ নামমাত্র পড়ে চলে গিয়েছিলেন ধনখড়।
আর ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বিজেপির বাধা সত্ত্বেও, গোলমাল উপেক্ষা করে রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণ গোটাটা পাঠ করলেন। শেষে দেখা গেল স্পিকার ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রীতি মেনে বাকি কাজও সারলেন বিধানসভা চত্বরে। এক বছর আগে যে বিজেপি বিধায়করা ‘রাজ্য সরকার হায় হায়’ ধ্বনি তুলেছিলেন তাঁরাই বুধবার ‘রাজ্যপাল হায় হায়’ ধ্বনি তুললেন।
গত বছর বাজেট অধিবেশনের আগে আগেই ছিল রাজ্যে পুরভোট। সেই ভোটে শাসকদলের সন্ত্রাসের অভিযোগে রাজ্যপালের বক্তৃতা শুরুর আগে থেকেই বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন বিজেপি বিধায়করা। একসময় বাজেট বক্তৃতা না করেই ফিরে যেতে চেয়েছিলেন রাজ্যপাল। এই ঘটনায় পাল্টা বিক্ষোভ শুরু করেন তৃণমূল বিধায়করা। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের কাছে বাজেট ভাষণের রীতিটুকু পালনের অনুরোধ জানান। দু’পক্ষের হাঙ্গামার পর প্রায় ১ ঘণ্টা পর রাজ্যপাল বাজেট ভাষণ সংক্ষিপ্ত ভাবেই শেষ করে রাজভবনে চলে যান।
তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, রাজ্যপালের বাজেট বক্তৃতা বন্ধ করে রাজ্যে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি করতে চেয়েছিল বিজেপি। এর পরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস জমা দেয় তৃণমূল পরিষদীয় দল। বিজেপি শিবিরও পাল্টা তৃণমূলের মহিলা বিধায়কদের বিরুদ্ধে রাজ্যপালকে হেনস্থার অভিযোগ তোলে। এর পরেই স্পিকার বিজেপি বিধায়ক মিহির গোস্বামী ও সুদীপ মুখোপাধ্যায়কে সাসপেন্ড করেন।
পরে অনেকে বলেছিলেন, পুরো বক্তৃতা না পড়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণের পিছনে রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল ধনখড় ও বিজেপির। কারণ, অধিবেশন শুরুর আগেই খসড়া বক্তৃতা নিয়ে তিনি নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন। আগে থেকেই আশঙ্কা ছিল অন্য কিছু ঘটতে পারে। আগে থেকেই তাই ঠিক ছিল, ধনখড়ের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে না। বিধানসভা সূত্রে জানা গিয়েছিল, আগে থেকেই এমন সিদ্ধান্তও হয়ে যায় যে, রাজ্যপাল যদি মন্ত্রিসভার অনুমোদিত ভাষণের বাইরে কিছু বলেন, বিধানসভার অধিবেশনে তা ‘রেকর্ড’ করাও হবে না।
রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর রাজ্যপালের ভাষণ দিয়ে বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। তার পরে নির্ধারিত দিনে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট-প্রস্তাবের পরেই অর্থ বিল পেশ করা হয়। এই বিল পেশের আগে রাজ্যপালের অনুমোদন লাগে। ২০২০ এবং ২০২১ সালেও মন্ত্রিসভার তৈরি করা বক্তৃতা নিয়ে নিজের অমত ব্যক্ত করেছিলেন ধনখড়। ২০২০ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র রাজভবনে দেখা করতে গেলে বাজেটের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষত অর্থ বিল সম্পর্কে সবিস্তার ব্যাখ্যা চান রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। অতীতে বিধানসভায় পেশের আগে অর্থ বিলে অনুমোদন পেতে রাজ্যপালের কাছে আগাম কোনও ব্যাখ্যা দিতে হয়নি রাজ্য সরকারকে। ২০২১ সালে তো খসড়া ভাষণ নিয়ে প্রকাশ্যে আপত্তি তুলেছিলেন ধনখড়। সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘খসড়া পড়ে দেখি, যা লেখা আছে তা বাস্তব নয়। ভাষণের খসড়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছি। যা নিয়ে আমার আশঙ্কা, তা নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এটাই রাজ্যপালের কাজ। চিঠি দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কাছে মুখ্যমন্ত্রীর ফোন আসে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য মন্ত্রিসভা খসড়া অনুমোদন করেছে।’’
কিন্তু ২০২২ সালের বাজেট অধিবেশের প্রথম দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকে। অতীতে যা হয়নি তাই করেন ধনখড়। বিজেপির বিক্ষোভ চলছিল শুরু থেকেই। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরও বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে না আসায় বিধানসভা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন রাজ্যপাল। সেই সময় বিধানসভার সব গেটই বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজ্যপাল নিজের আসনে বসে পড়ার পর চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে তৃণমূল মহিলা বিধায়করা রাজ্যপালের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে পারেন। তাঁকে আটকানোর চেষ্টা চলে। ওই পরিস্থিতির মধ্যে রাজ্যপাল কখনও বসে পড়ছিলেন, কখনও তাঁর আসন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল বিধায়কদের অনুরোধে ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে গোটা ভাষণের প্রথম ও শেষ লাইন।
বুধবারও বিধানসভায় হইহট্টগোল করেছেন বিজেপি বিধায়করা। কিন্তু তার মধ্যেই গোটা ভাষণ পড়েছেন আনন্দ। চোখমুখ বলেছে, পড়েছেন আনন্দের সঙ্গেই। সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে। উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়ও কি দেখলেন! এই রাজ্যে ৪টি বাজেট অধিবেশনে ছিলেন তিনি। কোনও বারই সরাসরি সম্প্রচার হয়নি।