প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
হাই কোর্ট পাড়ায় নগর দায়রা আদালত চত্বরের চিলতে মসজিদে আবেগে কাঁপছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। ইফতারের আগের মুহূর্তের প্রার্থনা করছিলেন বর্ধমানের মেমারির মাস্টারমশাই কাজী মহম্মদ ইয়াসিন। দেশকে ভালবাসা যে মুসলিমদের ইমান বা ধর্ম বিশ্বাসের অঙ্গ তা বোঝাতে রমজানি সাঁঝে নিয়মিত মহানবি হজরত মহম্মদের জীবনের গল্প শোনান ইয়াসিন।
“নিজের জীবনে অনেক কষ্ট, অত্যাচার সয়েছেন নবিজি। মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা সয়েছেন। তিনিই নিজের দেশ, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে শিখিয়েছেন। আমরা এই রাজ্য, এই দেশে জন্মেছি, এখানে ছিলাম, আছি, থাকব, অন্য কোথাও মাটি হলে তৃপ্তি পাব না। আল্লা তুমি আমাদের এই তৌফিক (পথ নির্দেশ) দান করো, আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি…!”
লোকসভা ভোট ঘোষণার ঠিক আগে রমজান মাসের শুরুতেই এ দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) চালু হয়েছে। সিএএ-র সঙ্গে এনআরসি-র অমিত শাহ কথিত কাল পরম্পরা বা ক্রোনোলজি তত্ত্ব তার পর থেকেই জনমানসে ছেয়ে আছে। পরে মোদী, অমিত শাহ তা অস্বীকার করলেও ভবিষ্যতে দেশছাড়া হওয়ার আতঙ্ক থেকে মুসলিম সমাজের একাংশ বেরোতে পারেনি। রমজান মাসের প্রাত্যহিক উপবাস ভঙ্গের সময়ে ইফতারের দোয়ায় তার ছাপ পড়ছে। অল বেঙ্গল ইমাম মুয়াজ্জিন অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড চ্যারিটেবল ট্রাস্টের রাজ্য সম্পাদক নাসিরুদ্দিন বিশ্বাস বলছিলেন, “ইফতারের সময়কার দোয়ায় আমরা দলীয় রাজনীতির কথা বলি না। কিন্তু যা পরিস্থিতি দেশকে ভালবাসার কথা চলে আসছেই!” ভোট-আবহে সিএএ বা এনআরসি-জুজুর ছায়া পড়াও তিনি অস্বীকার করছেন না।
রমজানের ২৭তম রোজার প্রাক্কালে শনিবার সন্ধ্যায় মুর্শিদাবাদের সুতি-২ ব্লকের দীঘি গ্রামে ইফতার শুরুর আগে তিনি বলছিলেন, “ভোটের বছরে এটাও বলছি, যাকে খুশি ভোট দিন কিন্তু হিংসার শিকার হবেন না। সেই সঙ্গে সম্প্রীতির কথা, দেশের সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার কথাও বলা হচ্ছে।” রাজ্যের ৬০-৭০ হাজার ইমাম, মুয়াজ্জিনের উদ্দেশে নাসিরুদ্দিনের একটি ভিডিয়ো বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে।
মেমারির ইয়াসিন বা যাদবপুরের ইমাম মহম্মদ মনিরুল ইসলামও ইফতারের দোয়ায় বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা বলছেন। রাষ্ট্ররিজ্ঞানের কলেজ শিক্ষিকা নওশিন বাবা খান সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা শোনালেন। এনপিআর-এনআরসি বিরোধী একটি মঞ্চের ঘরোয়া বৈঠকে বাংলা ও অসমের কয়েক জন বন্ধু মিলে কথায় কথায় ইফতারের সময় হয়ে গিয়েছে, তা হিন্দু বন্ধুরাই খেয়াল রেখেছিলেন। জনা কুড়ির মধ্যে সেখানে মুসলিম ছিলেন পাঁচ-ছ’জন। নওশিন বলেন, “ ইফতারের সময় হতে আমাদের বন্ধু জিতেনদা, কমলদারা এগিয়ে এসে রোজাদারদের ফল, সরবতের ব্যবস্থা করলেন। মিটিংয়ে এত ক্ষণ ওঁরাও চা, জল খাননি। রমজান মানে এই সহমর্মিতারই প্রকাশ।”