২০১১ সালে বর্ধমান ‘চাইল্ডলাইন’-এর পথ চলা শুরু। প্রথম দিকে যখন ‘চাইল্ডলাইন’ একেবারেই নতুন, তখন আমাদের কাজ করতে খুবই অসুবিধা হতো। প্রথমে আমরা প্রতিটি ব্লক, পঞ্চায়েত, পুলিশ স্টেশনে ‘চাইল্ডলাইন’ কী ও এর কার্যকারিতা কোথায়, সে বিষয়ে জানাই এবং তাদের আমাদের হেল্পলাইন নম্বর ১০৯৮-এর সঙ্গে পরিচয় করাই।
প্রথম দিকে কিছু সমস্যা ছিল। তা পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে সংযোগসূত্র তৈরি করাতেই হোক, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে গিয়ে নাবালিকার বিয়ে দিতে ইচ্ছুক পরিবারকে বোঝানোতেই হোক বা কোনও শিশুর চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে গিয়ে সমন্বয়গত কারণে। আস্তে আস্তে ‘সিডব্লিউসি’ (চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি) গঠিত হয়। গঠিত হয় ‘ডিসিপিইউ’ (ডিস্ট্রিক্ট চাইল্ড প্রোটেকশন ইউনিট)। প্রতিটি থানার এক সিনিয়র অফিসারকে শিশু সংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিডিওদের নিজ নিজ ব্লকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও শিশু সংক্রান্ত অন্য অভিযোগে নজর দিতে বলা হয়। এর ফলে আমাদের কাজ কিছুটা মসৃণ হয়। তবে এক-একটা ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করেছে।
তেমনই একটি ঘটনার কথা বলি। এক বার বছর চোদ্দোর মূক ও বধির একটি ছেলেকে আমরা বর্ধমানের ব্যস্ত রাস্তার ধার থেকে উদ্ধার করি। খিদে, কষ্টে তখন তার অসহায় অবস্থা। খাবার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে এক মূহুর্তে তা শেষ করে ফেলল। সে দিন ছেলেটির সঙ্গে কোনও কথা বলা সম্ভব হয়নি। পর দিন দেখি, সকাল থেকেই সে কান্না জুড়েছে। অসহায় ছেলেটি কোনও ভাবেই তার বাড়ির ঠিকানা আমাদের বোঝাতে পারছিল না। সে লিখতেও জানে না।
কোনও রকমে তার আকার-ইঙ্গিতে বুঝতে পেরেছিলাম, সে তাঁত বোনে। এতে আমাদের কাজ কিছুটা সহজ হয়। আমরা বর্ধমানের আশপাশে যে সব জায়গায় তাঁতের কাজ হয়, সেখানে ছেলেটির ছবি নিয়ে গিয়ে খোঁজ করতে থাকি। অনেক খোঁজার পরে অবশেষে আমরা ছেলেটির পরিবারের সন্ধান পাই। ছেলেটিকে তার মার কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে যে অনুভূতি হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই।
আরও একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। এক দিন সকালে বছর পনেরোর একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের অফিসে এসে উপস্থিত। কথায় কথায় জানতে পারি, মেয়েটি মাস ছয়েক আগে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছে। আর খুব অল্প দিনের মধ্যেই সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। সংসারের যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, তার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক। নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি সংসারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। সে আবার তার স্কুল জীবনে ফিরে যেতে চায়। মেয়েটিকে নিয়ে আমরা তার শ্বশুরবাড়িতে যাই। ওঁদের বোঝানো হয়, তারাও মেনে নেন বিষয়টি। শেষমেষ, প্রশাসনিক সহযোগিতায় আমরা মেয়েটিকে তার বাবা-মার হাতে তুলে দিই। সে আবার তার পুরনো জীবন ফিরে পেয়েছে। মেয়েটির ভাল থাকা আমাদেরও উৎসাহিত করেছে।
‘চাইল্ডলাইন’ কী ভাবে কাজ করে?
কোনও অভিভাবকহীন শিশুর সন্ধান পাওয়ার পরে স্থানীয় থানায় শিশুটির সমস্ত বিবরণ দিয়ে জেনারেল ডায়েরি করা হয়। তার পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশুটিকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিতে পেশ করা হয়। পরে শিশুটির সমস্যা, বাড়ির ঠিকানা জেনে সেই অনুযায়ী অন্য চাইল্ডলাইন, থানা এবং ‘ডিসিপিইউ’-এ যোগাযোগ করা হয়। শিশুটির বাড়ি খুঁজে বার করে সেখানে তার সুরক্ষা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এখনও পর্যন্ত আমরা ১৫০০-র বেশি শিশুকে নিরাপদে তাদের বাড়িতে ফিরিয়েছি।
আশাপ্রদ ভাবে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও আমরা এখন অনেকটাই সফল। বাল্যবিবাহের কোনও অভিযোগ পাওয়ার পরে আমরা স্থানীয় থানা, বিডিও, ‘ডিসিপিইউ’-কে জানাই এবং সকলের সহায়তায় ব্যবস্থা নিই। মেয়েটির বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তার খোঁজখবর নিই। বাল্যবিবাহ রুখতে গিয়ে আমরা নানা বাধার মুখে পড়ি।
অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির লোকজন বলতে শুরু করেন, মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে যে টাকা খরচ করা হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ কী ভাবে সম্ভব! অথবা, এক বার বিয়ে ভেঙে গেলে আবার বিয়ে হওয়া কঠিন হতে পারে। এই সমস্ত অজুহাতে তাঁরা বিয়ে বন্ধ করতে অস্বীকার করেন। অনেক সময়েই নাবালিকা মেয়েরা বাল্যবিবাহের অপকারিতা বুঝতে পারে না, তারা বিয়ে করতে আপত্তি করে না। বিয়ের আসরে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরাও অনেকে বাধা দেন। আমরা নাবালিকার অভিভাবকদের মেয়ের সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না দেওয়ার মুচলেকা লিখে দিতে বলি।
বাধা আছে, সমস্যা আছে। ‘চাইল্ডলাইন’ হয়তো সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যায়।
লেখক বর্ধমান চাইল্ডলাইনের কো-অর্ডিনেটর