ছায়ার খোঁজে শ্রমিক। হুগলির বাঁশবেড়িয়ায়। ছবি: তাপস ঘোষ
প্রকৃতির মেজাজমর্জি সব সময়েই দুর্বোধ্য। চলতি গরমের মরসুমে সেটা আরও বেশি করে মালুম হচ্ছে। সাধারণ ভাবে যেখানে দহন তুলনায় বেশি হওয়ার কথা, রাজস্থানের সেই মরু এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় সাত থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম আছে। উল্টো দিকে স্বাভাবিকের থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রি উপরে উঠে গিয়েছে দার্জিলিঙের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। কালিম্পঙের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের থেকে প্রায় তিন ডিগ্রি বেশি। অর্থাৎ পারদের ঊর্ধ্বগতিতে মরুভূমিকে হারিয়ে দিয়েছে হিমালয়! সিকিমের একাংশে তো তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি চলছে। বৃহস্পতিবার আবহাওয়া দফতর গ্যাংটক, তাডং, নামচিতে তাপপ্রবাহের সতর্কতা দিয়েছে। রীতিমতো পুড়ছে হিমালয়ের পাদদেশের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারও। পয়লা জুনেই বাঙালির জন্য আরও দুঃসংবাদ শুনিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। আগামী দিন সাতেক প্রবল গরমের সঙ্গে জুড়বে ঘ্যানঘেনে ঘামের দুঃসহ অস্বস্তি। বিভিন্ন জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতাও দিয়েছে হাওয়া অফিস।
মৌসম ভবনের খবর, রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর তীব্র গরম আর তীব্র ঠান্ডা দুইয়ের জন্যই বিখ্যাত। বৃহস্পতিবার সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৭.১ ডিগ্রি, স্বাভাবিকের থেকে ১৫ ডিগ্রি কম। মরুশহর জয়সলমেরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৫.৪ ডিগ্রিতে এবং সেটাও স্বাভাবিকের থেকে সাত ডিগ্রি কম। এ দিকে, এ দিন দার্জিলিঙের তাপমাত্রা উঠেছে ২৫.২ ডিগ্রিতে, স্বাভাবিকের থেকে ৫.৫ ডিগ্রি বেশি। কালিম্পঙের তাপমাত্রা ছিল ২৮.৬ ডিগ্রি, স্বাভাবিকের থেকে ২.৯ ডিগ্রি বেশি। গ্যাংটক সংলগ্ন তাডংয়ের তাপমাত্রা ৩১.৬ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যদি ৩০ ডিগ্রি বা তার বেশি হয় এবং স্বাভাবিকের থেকে তার ফারাক হয় পাঁচ ডিগ্রি, তা হলেই সেটাকে তাপপ্রবাহ বলা হয়। শুধু এ দিন নয়, মঙ্গলবারেও বেশ কিছু মরু অঞ্চলকে টেক্কা দিয়েছিল দার্জিলিং, কালিম্পং এবং সিকিমের বিভিন্ন এলাকা।
এপ্রিলেই এক দফা প্রবল তাপে দগ্ধ হয়েছে বঙ্গ। এ বার পাহাড়ি এলাকার গরমও বিস্মিত করেছে আবহবিদদের। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের সিকিমের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘‘আমার কর্মজীবনে সিকিমে কখনও তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি হবে বলে ভাবিনি! বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বিভিন্ন জায়গায় স্বাভাবিক আবহাওয়ার ভারসাম্য যে নষ্ট হয়ে চলেছে, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’’
পশ্চিমের মরু এলাকার সঙ্গে সাগরপাড়ের বঙ্গের তফাত গড়ে দিয়েছে বৃষ্টি। আবহবিদেরা জানান, রাজস্থানের মরু এলাকায় টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশও মেঘলা। তার ফলেই তাপমাত্রা বাড়তে পারছে না। তা না-হলে এই সময়ে ওই এলাকায় পারদের ৪৩-৪৪ ডিগ্রি উত্থানও স্বাভাবিক বলেই গণ্য হয়। অন্য দিকে, গাঙ্গেয় সমভূমিতে বৃষ্টির দেখাই নেই। তেমন বৃষ্টির আশা নেই আগামী কয়েক দিনেও। শুধু শনিবার উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে বৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু তাতেও গরমের দাপট তেমন কমবে বলে মনে করছেন না আবহবিজ্ঞানীরা। বরং আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আজ, শুক্রবার পশ্চিম বর্ধমান, দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মালদহ এবং দুই দিনাজপুর তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে পারে। শনি থেকে সোমবার দুই বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রাম, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদহ এবং দুই দিনাজপুরে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা আছে। মঙ্গল ও বুধবার গাঙ্গেয় বঙ্গের জেলাগুলি, মালদহ এবং দুই দিনাজপুরে তাপপ্রবাহ বইতে পারে।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, খাতায়-কলমে তাপপ্রবাহ হল কি না, সেটা বড় কথা নয়। আগামী কয়েক দিন রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই প্রবল এবং অস্বস্তিকর গরম পড়বে, এটা বলা যায়। তাঁর ব্যাখ্যা, তাপপ্রবাহ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানত দু’টি শর্ত থাকে। ১) ন্যূনতম ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। ২) স্বাভাবিকের থেকে তার ফারাক কমপক্ষে পাঁচ ডিগ্রি। এপ্রিলের প্রবল তাপপ্রবাহের তুলনায় এ বার তাপমাত্রা আরও বাড়লেও স্বাভাবিক তাপমাত্রা আগের থেকে বেশি আছে। তাই অঙ্কের নিয়মে সব ক্ষেত্রে পাঁচ ডিগ্রি ফারাক হচ্ছে না। সেই জন্য অনেক জায়গায় খাতায়-কলমে তাপপ্রবাহ না-হলেও গরমের অনুভূতিতে তার প্রভাব পড়বে না।
গরম যে প্রবল হবে এ দিনেই তা মালুম হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে তাপমাত্রা ৪০-৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। কলকাতা, তার উপকণ্ঠে দমদম, সল্টলেকের তাপমাত্রা ৩৮-৩৯ ডিগ্রির কাছাকাছি ছিল। গরমের দাপট চলছে হাওড়া, হুগলির মতো উপকূলবর্তী জেলা এবং মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুরের মতো গৌড়বঙ্গের জেলাতেও। সূর্যাস্তের পরেও গায়ে বাতাস লাগেনি বরং বাড়তি আর্দ্রতার জন্য ঘামতে হয়েছে দরদরিয়ে। শহরাঞ্চলে থাকা লোকজনের অভিজ্ঞতা, সিলিং ফ্যানের হাওয়াও যেন গায়ে লাগছে না। দিনের বেলায় রোদে বেরোলে দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। তার জেরে অনেকেই অসুস্থ বোধ করছেন।