নিজেদের কণ্ঠে নিজেদের কথা বলুক বঞ্চিতেরাই। তবেই সংবাদমাধ্যমের সততা এবং প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকবে। এমনই ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন এক সংবাদপত্র, যার সাংবাদিকদের বয়স চোদ্দো থেকে সতেরো। আর যাদের অবস্থান শহর থেকে অনেক দূরে, প্রত্যন্ত মফস্সলে আর গ্রামে।
কয়েক জন কিশোরীর উদ্যোগে চালিত ‘নজরে খবর’ নামে এই চার পাতার সংবাদপত্র খুঁটে আনছে কালচিনি, মহম্মদবাজার, বেলডাঙা, হরিহরপাড়ার মতো প্রত্যন্ত এলাকার শিশু পাচার, পানীয় জলের অভাব, ঢালাও মদ বিক্রির মতো সমস্যাকে। অসুবিধার কথা লিখছে ভুক্তভোগী কিশোরীরাই। সেই লেখায় পালিশ করা সাহিত্য নেই। তবে বঞ্চনার স্বরে ততটাই তীক্ষ্ণতা আছে, যা দিয়ে বিদ্ধ করা যায় পাঠকের চিন্তাকে।
এমনই কিছু সাংবাদিককে নিয়ে বুধবার আমেরিকান সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সূত্রধর মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘‘এই কিশোরীরা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে যে-ভাবে ‘খবর’ আনছে, তা মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যমে জায়গা পাওয়ার দাবি রাখে।’’ হরিহরপাড়ার স্কুলপড়ুয়া সুপ্রিয়া সরকার এই সংবাদপত্রের কমিউনিটি রিপোর্টার। তার রিপোর্টে উঠে এল সুমিতা খাতুন নামে বছর ষোলোর এক কিশোরীর জীবনযন্ত্রণার কথা। অভাবের সংসারে কুড়ি হাজার টাকার ধার মেটাতে না-পারায় যাকে বিক্রি হয়ে যেতে হয় পাচারকারীদের হাতে। পুলিশ সুমিতাকে ফিরিয়ে আনলেও পাচারকারীরা পলাতক।
চা-বাগানের শ্রমিক পরিবারের নাবালিকারা কী ভাবে ভুটানের ফুন্টশোলিংয়ের পতিতালয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেটাই রিপোর্ট করল কালচিনির ছাত্রী প্রিন্সকা সোরেন। গলা তুলে অভিযোগ করল, প্রশাসন দেখেও দেখছে না। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার কিশোরী সাংবাদিক শাবানা জানাল, পাচার হতে হতে এক নাবালিকাকে ট্রেন থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল কী ভাবে। আলিপুরদুয়ারের স্বর্ণালীর প্রতিবাদ, এলাকায় ঢালাও দেশি মদের ঠেকের দাপটে মেয়েদের পথে বেরোনোই দায়। মহম্মদবাজারের নার্গিসের রিপোর্ট, পানীয় জলের অভাবে শুধু যে রোজকার জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, তা-ই নয়। এই কারণে স্কুলছুট হতে হচ্ছে অনেক বাচ্চাকে। জল আনতে অনেক দূরে যেতে হয় বলেই স্কুলে যাওয়া হয় না তাদের।
অবাক করে দেওয়া সপ্রতিভতায় প্রতিটি প্রতিবেদন উপস্থাপিত করল কিশোরীরা। উত্তর দিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের। প্রখর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করল, ‘‘পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, সত্যিকার খবরের স্বার্থে শেষ দেখে ছাড়ি, ভবিষ্যতেও ছাড়বো।’’
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন মহিলা ইতিহাসবিদ, ‘উইমেন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’র লেখক জেরাল্ডিন ফোর্বস। বাংলার কিশোরীদের এই চেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।