ধৃত উজ্জ্বলভাস্কর ঘোষ।—নিজস্ব চিত্র।
স্ত্রীকে খুন করতে সুপারি কিলার ভাড়া করেছিলেন এক শিক্ষক। তিন দিন আগে সেই ‘কাজ’ হয়েও যায়। কিন্তু, শেষ রক্ষা হল না। শনিবার এই খুনের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় ওই শিক্ষককে। ধৃতের নাম উজ্জ্বলভাস্কর ঘোষ। পুলিশি জেরায় স্ত্রীকে সুপারি দিয়ে খুনের কথা স্বীকার করেন তিনি। রবিবার তাঁকে কাটোয়া মহকুমা আদালতে হাজির করানো হবে।
ধৃতের সাত বছরের ছেলে ইন্দ্রজিত্ পুলিশের কাছে জানিয়েছে, সে দিন রাতে দু’জন লোক তার মাকে মেরেছে। সে দেখে ফেলায় তাকে ঘর থেকে বের করে ঠাকমার কাছে পাঠিয়ে দেয় বাবা। কাউকে কিছু বললে, তাকেও মারা হবে বলে ছেলেকে হুমকি দেন ওই শিক্ষক।
দাঁইহাট চরপাতাইহাট হাইস্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক উজ্জ্বলভাস্কর ঘোষ। বাড়ি কাটোয়ারই আবাসন পাড়ায়। পুলিশ সূত্রে খবর, ২০০৯ সালে বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের গঙ্গারামপুরের মহুয়া ঘোষের সঙ্গে ওই তাঁর বিয়ে হয়। বিয়েতে ৭ লাখ টাকা নগদ এবং ১০ ভরি সোনা যৌতুক হিসাবে নিয়েছিলেন উজ্জ্বল। তখন তাঁরা কেতুগ্রামে থাকতেন। ওখানেই উজ্জ্বলের পৈতৃক বাড়ি। প্রথম দিকে সম্পর্ক ভাল থাকলেও ২০১০-এ ছেলে হওয়ার পর তাঁদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। মহুয়ার পরিবারের অভিযোগ, অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল উজ্জ্বলের। এমনকী, মহুয়ার উপর অত্যাচারও করতেন তিনি। সে কারণেই কেতুগ্রাম থানায় স্বামীর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতন এবং খোরপোশ দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। সেই মামলা রামপুরহাট আদালত অবধি গড়ায়। আদালত মহুয়াকে মাসিক খোরপোশের দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয় উজ্জ্বলকে। তখন থেকেই ছেলেকে নিয়ে গঙ্গারামপুরে বাপের বাড়িতেই থাকতেন ওই বধূ।
আরও পড়ুন: ভাসছে দক্ষিণবঙ্গ, জলমগ্ন কলকাতা, আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস
কিন্তু, কয়েক মাস দেওয়ার পর উজ্জ্বল সেই মাসোহারা বন্ধ করে দেন। ২০১৪ সালে এ নিয়ে কেতুগ্রাম থানায় অভিযোগ করেন মহুয়া। তখন পুলিশ উজ্জ্বলকে আটক করে থানায় এক দিন লকআপে রেখে দেয়। পুলিশের দাবি, সেখানেই এক দাগি অপরাধীর সঙ্গে পরিচয় হয় উজ্জ্বলের। স্ত্রীকে খুন করার জন্য লকআপেই তার সঙ্গে পরিকল্পনা করেন তিনি। এ জন্য আগাম এক লাখ টাকা অগ্রিমও দেন। তত দিনে উজ্জ্বল কাটোয়ার আবাসন পাড়ায় একটি বাড়ি কিনেছেন।
প্রথমে ঠিক হয়, বীরভূমের বাড়িতে গিয়ে ওই মহিলাকে খুন করবে কিলাররা। সেখানে মহুয়ার বাবা-মা থাকায় সমস্যা হতে পারে ভেবে বিষয়টা থেকে পিছিয়ে আসে তারা। এর পর মূল চক্রী গাঁজার মামলায় গ্রেফতার হয়। ইতিমধ্যে সে স্ত্রীকে কাটোয়ার বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য উজ্জ্বলকে পরামর্শ দেয়। সেই মতো ওই বছরই উজ্জ্বল স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে গোটা ঘটনা মিটিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাটোয়ায় নিয়ে আসেন। গত তিন বছর ধরে তাঁদের মধ্যে কোনও বড় ধরণের গণ্ডগোল হয়নি।
কিন্তু, হঠাত্ করেই গত ১০ জুলাই ওই দম্পতির মধ্যে বচসা বাধে। তার পরেই ফের সুপারি কিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন উজ্জ্বল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্ত্রীকে খুনের জন্য জোর করেন ওই শিক্ষক। এ জন্য ফের ২ লাখ টাকা সুপারি দেন তিনি। এর পর গত ১৮ জুলাই রাতে উজ্জ্বলের বাড়িতে বাইকে চেপে দুই কিলার আসে। নিজের শোওয়ার ঘরে তাদের ঢুকিয়ে দেন উজ্জ্বল নিজেই। তার পর ওই দু’জনের সঙ্গে মিলে তিনি স্ত্রীর বুকের উপর উঠে তাঁর মুখে প্ল্যাস্টিক গুঁজে, বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেন। এই ধস্তাধস্তি যখন হচ্ছে, তখন ঘুম থেকে উঠে পড়ে ইন্দ্রজিত্। মায়ের কী হয়েছে, জিজ্ঞেস করায় তাকে ঙর থেকে বের করে দেন উজ্জ্বল। এর পর ওই শিক্ষকেরই বাইকে চাপিয়ে মহুয়ার দেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে বেরিয়ে যায় খুনিরা। কিন্তু, মাঝপথে রেলগেট পড়ে যাওয়ায় তারা মহুয়ার মুখ অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে পানুহাট দিঘিরপাড়ে ফেলে দেয়। পুলিশ পরে ওই ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ মহিলার দেহ কাটোয়া হাসপাতালে নিয়ে যায়।
অন্য দিকে, উজ্জ্বলের মা ইন্দ্রজিত্কে নিয়ে কেতুগ্রামে তাঁর বাপেরবাড়ি চলে যান। খবর দেন মহুয়ার পরিবারকে। জানান, তাঁদের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একই কথা বলা হয় কাটোয়ার দুই প্রতিবেশীকে। উজ্জ্বলও খুনের পর দু’দিন স্কুলে যান। কেউ কিছু বুঝতেও পারেননি। এর পর মহুয়ার পরিবারের লোকজন কাটোয়ায় আসে। প্রতিবেশীরা গতকাল বিকেলে উজ্জ্বলকে চেপে ধরতেই অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন তিনি। তার পর তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর পর পুলিশি জেরাতেই সব কথা স্বীকার করেন ওই শিক্ষক। এ দিন উজ্জ্বলের মাকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ।