তালড্যাংরা উপনির্বাচনে তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেসের প্রার্থী উৎকল সম্প্রদায়ভুক্ত। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটে বাঁকুড়ার তালড্যাংরায় ছিল ত্রিমুখী লড়াই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তৃণমূল, বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস জোটের মধ্যে। সেই ভোটে তিন প্রার্থীই ছিলেন বাঙালি। তিন বছর পরে সেই তালড্যাংরায় উপনির্বাচনে চতুর্মুখী (বাম এবং কংগ্রেস আলাদা প্রার্থী দিয়েছে) লড়াইয়ে তিন জন প্রার্থীই উৎকল সম্প্রদায়ভুক্ত।
তৃণমূল প্রার্থী করেছে ফাল্গুনী সিংহবাবুকে। সিপিএমের প্রতীকে লড়ছেন দেবকান্তি মোহান্তি। আর কংগ্রেসের প্রার্থী তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহি। তিন জনেরই শিকড় উৎকল। শুধু বিজেপির প্রার্থী বাঙালি— অনন্যা রায়। যিনি বাঁকুড়া শহরের বাসিন্দা। আগে তৃণমূলের স্থানীয় নেত্রী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে যে ছ’টি আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে, তার মধ্যে বাঁকুড়ার তালড্যাংরাতেই এই ‘অভিনব’ ঘটনা ঘটছে। যেখানে বাংলা এবং বাঙালির চেয়ে উৎকলের দাপট বেশি।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের হয়ে তালড্যাংরা থেকে জিতেছিলেন অরূপ চক্রবর্তী। সিপিএমের হয়ে লড়েন মনোরঞ্জন পাত্র এবং বিজেপির প্রার্থী ছিলেন শ্যামল কুমার সরকার। তিন জনই বাঙালি। অরূপ লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হওয়ায় তিন বছরের মধ্যে উপনির্বাচন হচ্ছে তালড্যাংরায়। তবে ২০২১ সালের আগে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও ত্রিমুখী লড়াই হয়েছিল এই বিধানসভায়। সে বারও তিন জন প্রার্থীই ছিলেন বাঙালি।
উৎকল ভোটার রঙ্গ
তালড্যাংরা বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটার ২ লক্ষ ৬৪ হাজার। তার মধ্যে সিমলাপাল ব্লকেই ভোটার ১ লক্ষ ৩০ হাজার। অর্থাৎ, মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। সেই ১ লক্ষ ৩০ হাজারের মধ্যে উৎকল সম্প্রদায়ভুক্ত কমবেশি ৪৫ শতাংশ। ফলে সেই ভোট খানিকটা হলেও ‘নির্ণায়ক’। এ কথা ঠিক যে, রাজ্যের অন্য অনেক এলাকার মতো বাঁকুড়ার এই জনপদেও গত কয়েক বছর ধরে বামের ভোট বিজেপির দিকে যাচ্ছিল। সেই প্রবণতার কারণেই ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বাঁকুড়া আসন তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পদ্মশিবির। ২০২৪ সালে সেই ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে বাঁকুড়া পুনরুদ্ধার করেছে তৃণমূল। তবে লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে শাসকদল দেখেছে, তালড্যাংরা বিধানসভায় ‘লিড’ পেলেও উৎকল ভোট তারা পায়নি। সেই ভোট পড়েছে বিজেপির বাক্সেই।
অন্য দিকে, সিপিএম হিন্দু ভোট ফেরাতে কৌশল নিয়েছে। দলের নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, বিজেপির বাক্সে চলে যাওয়া হিন্দু ভোটের কিয়দংশও ফেরাতে হলে তালড্যাংরার সমীকরণ অনুযায়ী উৎকল সমর্থন ‘পাখির চোখ’ করতে হবে। হিন্দু ভোট ফেরাতে সিপিএম এতটাই মনোনিবেশ করেছে যে, রবিবার তালড্যাংরার লক্ষ্মীসাগরে সিপিএমের গণসংগঠনগুলি ‘গণফোঁটা’র কর্মসূচি নিয়েছে। এই এলাকাতেই সিপিএম প্রার্থীর বাড়ি। যেখানে উৎকলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কংগ্রেসের সামনে অবশ্য এত বিশ্লেষণের সুযোগ ছিল না। কারণ, গত কয়েকটি ভোটে তালড্যাংরায় তারা নিজেদের প্রতীকে লড়েনি। কিন্তু তারাও প্রার্থী হিসাবে এক উৎকল সম্প্রদায়ের মানুষকেই বেছে নিয়েছে।
উৎকল অঙ্ক
প্রকাশ্যে তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, ‘ভাল প্রার্থী’ বলে তাঁরা টিকিট করিয়েছেন। এর মধ্যে কোনও ‘সম্প্রদায়গত সমীকরণ’ নেই। তবে তালড্যাংরার জনবিন্যাস, গত লোকসভা ভোটের ফলাফল এবং চার-পাঁচ দশক আগের ভোটচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, সেখানকার উৎকল ভোটের উপর রাজনৈতিক দলগুলির ‘বাড়তি নজর’ দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। একান্ত আলোচনায় সে কথা মেনেও নিচ্ছেন তিন শিবিরের নেতারা।
বাঁকুড়ার তৃণমূল সাংসদ অরূপ বলেছেন, ‘‘ভাল প্রার্থী বলেই ব্লক প্রেসিডেন্টকে আমরা টিকিট দিয়েছি। এর মধ্যে অন্য কোনও বিষয় নেই।’’ তবে অরূপ এ-ও মেনে নিয়েছেন যে, তিনি লোকসভায় জিতলে বা তালড্যাংরা থেকে লিড পেলেও উৎকল সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। সিপিএম নেতা অমিয় পাত্র যেমন বলেছেন, ‘‘আমরা কোনও জাতিগত পরিচিতির ভিত্তিতে প্রার্থী করিনি। যিনি আমাদের প্রার্থী, তিনি পেশায় শিক্ষক, সমাজে তাঁর পরিচিতি রয়েছে, আরজি কর পর্বে তিনি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্বও দিয়েছেন। সে কারণেই আমরা তাঁকে প্রার্থী করেছি।’’
তৃণমূল সূত্রে খবর, তালড্যাংরায় প্রার্থী হওয়া নিয়ে দলের মধ্যে লড়াই ছিল। অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠেছিলেন এক নেত্রী এবং তাঁর স্বামী। সেই নেত্রী আবার জেলা পরিষদের বড় দায়িত্বে রয়েছেন। দলের অন্দরে তিনি সাংসদ অরূপের ‘বিরোধী’ শিবিরের বলেই পরিচিত। শাসকদলের একাংশের বক্তব্য, যতটা না উৎকল অঙ্কে তাদের প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছিল এমন এক জনকে প্রার্থী করার ভাবনা, যিনি হবেন সাধারণ ভাবে দলের মধ্যে ‘সর্বজনগ্রাহ্য’। তবে তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেস— তিন দলের প্রার্থীরই বাড়ি সিমলাপাল ব্লকে।
উৎকল পর্ব
১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তালড্যাংরায় যাঁরা বিধায়ক ছিলেন, তাঁরা সকলেই উৎকল সম্প্রদায়ের। ১৯৬৯ সালে সিপিএমের মোহিনীমোহন পন্ডা জিতেছিলেন কংগ্রেসের প্রদ্যোৎ সিংহচৌধুরীর বিরুদ্ধে। দু’জনেই ছিলেন উৎকল। ১৯৭১ সালে ফের যেতেন মোহিনীমোহন। ১৯৭২ সালে সিপিএমের উৎকল নেতা মোহিনীমোহনকে পরাস্ত করেন কংগ্রেসের উৎকল নেতা ফণীভূষণ ষন্নিগ্রহি। তার পরে ১৯৭৭ এবং ১৯৮২ সালের নির্বাচনে পর পর দু’বারই জেতেন মোহিনীমোহন। তবে ১৯৮৭ সালে সেই ধারায় ছেদ পড়ে। সিপিএমের হয়ে তার পর থেকে জিততে থাকেন অমিয়, মনোরঞ্জন পাত্ররা (তাঁরা উৎকল নন)। ২০১৬ সালে পর্যন্ত এই দুই বাঙালি নেতাই ছিলেন সিপিএমের বিধায়ক। ২০১৬ সালে জেতেন তৃণমূলের সমীর চক্রবর্তী (তিনিও উৎকল নন)। ২০২১ সালে অরূপ। অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে যে ধারায় ছেদ পড়েছিল, ৩৭ বছর পর তালড্যাংরায় সেই উৎকল সমীকরণ আবার ফিরে এসেছে।
সিপিএম আশাবাদী, উৎকল অঙ্কেই তারা বিজেপিতে যাওয়া ভোট কিছুটা হলেও ফেরাতে পারবে। তৃণমূলের নেতারা যে সমীকরণকে ‘ইতিবাচক’ বলেই মনে করছেন। কারণ, তাতে বিজেপির ভোট কমবে। ২৩ নভেম্বর দুপুরের মধ্যে জানা যাবে, তালড্যাংরায় আবার ‘উৎকলযুগ’ শুরু হল কি না!