বৃহস্পতিবার মারা যান অশ্রুকুমার সিকদার।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকালে মারা গেলেন রবীন্দ্রসাহিত্য ও বাংলা কবিতার গবেষক অশ্রুকুমার সিকদার (৮৭)।
শিলিগুড়ির বাবুপাড়ায় থাকতেন। বুধবার বিকেলে তাঁকে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। বৃহস্পতিবার সেখানেই মারা যান। নার্সিংহোম সূত্রের খবর, তাঁর হৃদ্রোগ ছিল, বার্ধক্যজনিত নানা রোগেও ভুগছিলেন। বেশ কয়েক মাস দৃষ্টির সমস্যাতেও ভুগছিলেন। ১৯৩২ সালের ৮ জানুয়ারি তরাইয়ের পাহাড়গুমিয়া চা বাগানে অশ্রুবাবুর জন্ম। পড়াশোনা শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলে। মাঝে কিছু দিন জলপাইগুড়ি থাকার পরে কলকাতা ছিলেন কয়েক বছর। আবার উত্তরবঙ্গে ফিরে আসেন। শিলিগুড়ি কলেজ এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ঘনিষ্ঠ ছিলেন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ পুলিনবিহারী সেনের। তাঁর কথাতেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অশ্রুবাবুর গবেষণা শুরু।
দেবেশ রায়ের সংযোজন: এই সে দিন, সে দিনই তো। মাস দুইও হয়নি। অশ্রুদা কলকাতায় এসেছিলেন। আমার ছোটভাই সমরেশ-এর সঙ্গে ওঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সমরেশই বলল— ‘অশ্রুদা কলকাতায় আসছেন, ওঁর বড় মেয়ের কাছে। বললেন, তোমার ওখানে একদিন খাব। দেবেশের সঙ্গে দেখা হবে।’ আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘মানেটা কী? অশ্রুদা আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে? আমি কে? কোথায় উঠেছেন?’ সমরেশ বেচারা দু-দিক থেকে ধমক খেল— ‘এই কাছেই, নাগেরবাজারে। ওঁর বড় মেয়ের বাড়ি। রিকশাতেই যাওয়া যায়।’ ‘তা হলে বল কবে যাবি—’।
বেশ কিছু দিন পরে দেখা। দু-চোখের কোনও চোখে দৃষ্টি নেই। শরীরের অন্য কোথাও কোনও দুর্বলতা চাক্ষুষ হল না। আমার পাশে চেয়ারে হেসে বসলেন। যত ক্ষণ ছিলাম, এক মুহূর্তের জন্য আমার হাত ছাড়েননি। যেন মনে হচ্ছিল, শুধু তাকিয়ে থেকে যেমন আশীর্বাদে স্নান করিয়ে দেওয়া যায়, ওঁর হাতটা সেই চোখ হয়ে উঠেছিল। এত চক্ষুষ্মান ছিল সেই স্পর্শ।
সে সবই ছিল আশীর্বাদ। এক সময় মনে হল উনি আমাকে ওঁর আশীর্বাদের বর্মে রক্ষা করতে চাইছেন।
সংকোচ এড়াতে আমি ওঁর লেখার কথায় গেলাম। ‘চোখ গেছে তো গেছে। আপনি বলে যাবেন, মেয়ে লিখে নেবে।’ কী করে কী করে যেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’-এর কথা উঠল। আমার বড় প্রিয় উপন্যাস। বললাম—‘উপন্যাস তো কারুকাজেরই লেখা অশ্রুদা। না? ঘটনা জানতে কি কেউ উপন্যাস পড়ে?’ অকম্পিত স্বরে বললেন, ‘চন্দ্রশেখর-এ চারটি সাঁতার আছে।’ আমি আবদার ধরে বসলাম—‘একটা ছোট লেখা লিখে দিন— চন্দ্রশেখরে সাঁতার। বলে দিন সমরেশ কবে আসবে, আপনি বলবেন, ও লিখে নেবে।’ বেশ জোরে হেসে উঠলেন যাকে সম্মতি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমি তো অশ্রুদাকে চিনি আমার স্কুল-পড়া বয়স থেকে। উনি তখন জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে বিজ্ঞান পড়েন। পরে কলকাতায় চলে এলেন বাংলা পড়তে। এমএ পাশ করে শিলিগুড়ি কলেজে বাংলার অধ্যাপক। নিজের মনের মতো করে তৈরি করে তুলেছিলেন সে কলেজের লাইব্রেরি। তাঁর পড়াশোনার বিস্তার, স্মৃতিশক্তি ছিল বিপুল। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলার অধ্যাপক হিসাবেই চাকরি জীবন শেষ করেন। আমি জানি, ওই যে আমি বললাম উপন্যাস তো কারুকাজের নির্মাণ আর উনি ‘চন্দ্রশেখর’-এর সাঁতারের সংখ্যা নির্ভুল বলে দিলেন—তার মধ্যে কত বিনিময় ছিল।
অশ্রুদার প্রয়াণে আমাদের উত্তর বাংলার এই যে ক্ষতি হয়ে গেল তা আর পূরণ হওয়ার নয়। যাকে বলে দিশা, মিনার, গম্বুজ তা তো সারা জীবন ধরে গড়ে ওঠে। চিরজীবন শিলিগুড়িতে থেকেও অশ্রুদা নিজেকে সেই মিনার করে তুলেছিলেন। উত্তর বাংলার সঙ্গে দুনিয়ার সম্পর্ক বা সংকেত ছিল ওই মিনার।
বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজ তৈরি হলেই মিনার গড়ে ওঠে না। মিনার গড়ে ওঠে ব্যক্তির জিজ্ঞাসা তৈরির হিম্মতে, উত্তর খোঁজার সাহসে কোনও সুলভ উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে না-যাওয়ার পরাক্রমে।
অশ্রুদা যে শূন্যতা তৈরি করে গেলেন, তাতে আমরা উত্তর বাংলার বিদ্যার্থীরা বড় দীন হয়ে গেলাম। যত দিন যাবে সে দীনতার হাঁ ততই বাড়বে।