পশ্চিমবঙ্গে শব্দ-অসুরের দাপট রুখতে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। আবেদন করেছিল, এ রাজ্যে বাজির শব্দ-সীমা যেন ১২৫ ডেসিবেলের বদলে ৯০ ডেসিবেলেই বাঁধা থাকে। কিন্তু সেখানে আপাতত কোনও সুরাহা হল না। বিষয়টির ভবিষ্যৎ চলে গেল জাতীয় পরিবেশ আদালতের হাতে।
শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এইচএল দাত্তু ও বিচারপতি অমিতাভ রায়ের বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, পর্ষদকে প্রথমে নিজের বক্তব্য জাতীয় পরিবেশ আদালতে (গ্রিন ট্রাইব্যুনাল) পেশ করতে হবে, ট্রাইব্যুনালের আস্থা অর্জন করতে হবে। ফলে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও স্বেচ্ছাসেবীদের দায়ের করা মামলাটির ভাগ্য এই মুহূর্তে জাতীয় পরিবেশ আদালতের সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করছে। যদিও সেখানে কবে নিষ্পত্তি হবে, তা অনিশ্চিত।
এবং ওই ফয়সালা না-হওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল-ই থাকছে। অন্তত আসন্ন দুর্গাপুজো, কালীপুজোর সময়ে যাতে শব্দবাজিতে লাগাম পরানো যায়, সুপ্রিম কোর্টের কাছে এ দিন তার অনুমতি চেয়েছিল পর্ষদ। বেঞ্চ মানেনি। ‘ট্রাইব্যুনালই পুরো বিষয়টি দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।’— বলে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
কেন্দ্রীয় আইন মোতাবেক বাজির শব্দ-সীমা ১২৫ ডেসিবেল হলেও বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৯৭-এ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঞ্চ পশ্চিমবঙ্গে তা ৯০ ডেসিবেলে বেঁধে দিয়েছিল। গত ১৯ মে গ্রিন ট্রাইব্যুনালের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ পর্ষদকে নির্দেশ দেয়, দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও তা ১২৫ ডেসিবেল ধার্য করে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। এ হেন নির্দেশের বিরুদ্ধে পর্ষদ গত ১০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। পরে একই আবেদন নিয়ে যায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যৌথ সংস্থা ‘সবুজ মঞ্চ।’ সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য শোনার পরে তারা কী করবে?
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র এ দিন বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হাতে পেলে সেই মতো পরবর্তী পদক্ষেপ করব।’’
সুপ্রিম কোর্টে এ দিন রাজ্য দূষণ পর্ষদের হয়ে সওয়াল করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি। আদালতকে তিনি বলেন, কোনও রাজ্য চাইলে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আরও কড়া বিধি-নিষেধ বলবৎ করতে পারে। ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা যথেষ্ট, জনঘনত্বও অনেক রাজ্যের চেয়ে বেশি। তাই এখানে বাজির শব্দ-সীমা ৯০ ডেসিবেলে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।’’— যুক্তি দেন রোহতগি।
পর্ষদের আবেদনের বিরোধিতা করে বাজি প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি।’ পাল্টা সওয়ালে সমিতির কৌঁসুলি শুভাশিস ভৌমিকের দাবি: ১৯৯৭-এর পুরনো রিপোর্টের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ৯০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বসীমা ধার্য করেছে। যেখানে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নির্ধারিত ১২৫ ডেসিবেলের ভিত্তি হল গত মে মাসের বিশেষজ্ঞ-রিপোর্ট। ‘‘পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ঘন জনবসতির ১৭টি রাজ্যেও কিন্তু বাজির শব্দ-সীমা ১২৫ ডেসিবেল।’’— বলেন তিনি। সমিতির পাশে দাঁড়ানো ইন্টারন্যাশনাল মারওয়াড়ি অ্যাসোসিয়েশনের তরফে অশোক ভানের কটাক্ষ, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার ১২৫ ডেসিবেল বেঁধে দিয়েছে। অথচ কেন্দ্রের প্রধান আইনজীবী যিনি, সেই অ্যাটর্নি জেনারেল একটি রাজ্যের হয়ে তা কমানোর পক্ষে সওয়াল করছেন!’’
এ দিকে মে মাসে ট্রাইব্যুনাল এ-ও জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের জন্য আলাদা ঊর্ধ্বসীমা বাঁধতে হলে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়তে হবে। তারাই স্থির করবে, নতুন মানদণ্ডে রাজ্যে বাজির শব্দ-সীমা কত ডেসিবেল হওয়া উচিত। সেই রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে পেশ করতে হবে। প্রসঙ্গটি তুলে রোহতগি এ দিন আদালতকে বলেন, পর্ষদ নতুন বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়েছে, এবং কমিটির প্রাথমিক রিপোর্ট ৯০ ডেসিবেলের পক্ষেই রায় দিয়েছে। শুনে প্রধান বিচারপতি দাত্তু বলেন, ‘‘এ বার তা হলে পর্ষদ রিপোর্ট নিয়ে ট্রাইব্যুনালকে বোঝানোর চেষ্টা করুক। সুপ্রিম কোর্ট কোনও নির্দেশ দেবে না।’’
পর্ষদ-সূত্রের খবর: বিশেষজ্ঞ কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি হতে প্রায় দু’বছর লাগবে। এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে বাজির আওয়াজ কমার আশু সম্ভাবনা দেখছে না প্রশাসন বা ব্যবসায়ীমহল। শুভাশিসবাবুর কথায়, ‘‘আপাতত ১২৫-ই থাকছে।’’ আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমাদের ১৩ লক্ষ সদস্য। বাজি কারখানা ছ’লক্ষ। এতগুলো মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন। আমরা রাজ্যকে বছরে দু’শো কোটি টাকা কর দিই। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ, সরকার যেন আর মামলা না-করে।’’
সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবীরা অবশ্য এখনই হাল ছাড়ছেন না। ‘সবুজ মঞ্চ’-র তরফ থেকে নব দত্তের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সমাজের কাছে ১২৫ ডেসিবেল কাম্য নয়। প্রয়োজনে ফের ট্রাইব্যুনালে গিয়ে বোঝাতে হবে।’’ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন-আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ও এক মত। ‘‘এখন সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফের পরিবেশ আদালতে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।’’— বলেন তিনি।