সিঙ্গুরে বিজয় মিছিল। বুধবার প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে সিঙ্গুরে বাম সরকারের জমি অধিগ্রহণকে বেআইনি ও অবৈধ বলে রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় ২০০৬-এ সিঙ্গুরে টাটার একলাখি ন্যানো গাড়ির কারখানার জন্য যে ১০৫৩ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, তা আইন মেনে হয়নি। কারণ বেসরকারি সংস্থার কথায়, তাদের চিহ্নিত করে দেওয়া জমিই অধিগ্রহণ করেছিল রাজ্য সরকার। ওই জমি এ বার পুরনো মালিকদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ১০ সপ্তাহের মধ্যে কোন জমি কার ছিল, তা চিহ্নিত করে ফেলতে হবে। ১২ সপ্তাহের মধ্যে জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। সিঙ্গুরের মানুষের জন্য সুখবর হল, যাঁরা জমির ক্ষতিপূরণ ইতিমধ্যেই নিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁদের আর তা ফেরত দিতে হবে না। আর যে সব অনিচ্ছুক কৃষক ক্ষতিপূরণ নেননি, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য সরকার। কারণ তাঁদের কেউই গত দশ বছর জমি ব্যবহার করতে পারেননি।
সিঙ্গুরে জমি নেওয়ার বিরোধিতা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পরে এখন তাঁর বৃহস্পতি তুঙ্গে। রাজ্য প্রায় বিরোধী শূন্য। এর পরে সিঙ্গুরের রায় তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক জুড়ল। রায় শোনার পরে তাই তিনি তৃপ্তির হাসি হেসে বলেছেন, ‘‘আমি এখন শান্তিতে মরতেও পারি।’’ উল্টো দিকে এই রায় সিপিএমের কফিনে নতুন পেরেক পুঁতে দিল বলেই মনে করছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। কারণ সিপিএম তথা পূর্বতন বাম সরকার নিজেদের কৃষক-দরদি বলেই দাবি করে এসেছে। আদলত কার্যত তাদেরই কাঠগড়ায় তুলেছে। আদালত বলেছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার শিল্পসংস্থার দেখিয়ে দেওয়া জমি অধিগ্রহণ করেছে। কৃষকদের আপত্তি কানে তোলেনি। রায়ের পরে বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ‘‘বামেরা মুখে কৃষকস্বার্থের কথা বলে। অথচ কাজের বেলায় বেসরকারি সংস্থার জন্য জমি নিয়ে তাকে জনস্বার্থের নাম দেয়।’’
ক্ষমতায় এসেই সিঙ্গুরের জমি ফেরাতে আইন করেছিলেন মমতা। তার আগেই অবশ্য টাটারা গুজরাতের সানন্দে ন্যানো কারখানা সরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু টাটারা সিঙ্গুরে লিজ নেওয়া জমি ফেরাতে চায়নি। তারা মমতার আইনকে চ্যালেঞ্জ জানায়। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সেই আইনকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করায় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয় মমতার সরকারকে। অনিচ্ছুক কৃষকদের এক গুচ্ছ মামলাও ২০০৮ থেকে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলছিল। বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যেই একসঙ্গে ওই সব মামলার চূড়ান্ত শুনানিপর্ব শুরু হয়।
জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ঠিক ছিল কি না, প্রথম থেকেই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতিরা। তাঁরা বুঝতে চেয়েছেন, টাটারা জমি চিহ্নিত করার পর রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছে কি না। কারণ ১৮৯৪ সালের যে পুরনো জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী সিঙ্গুরে জমি নেওয়া হয়, তাতে বলা ছিল, শিল্পায়নের জন্য কোন জমি নেওয়া হবে, তা ঠিক করে জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ করবে। কোনও আপত্তি থাকলে তা শোনা হবে। অধিগ্রহণ হলে শিল্প সংস্থাকে জমি লিজ দেওয়া হবে। সিঙ্গুরে এই সব কোনও নিয়মই মানা হয়নি বলেই সুপ্রিম কোর্ট জমি অধিগ্রহণকে বেআইনি বলে খারিজ করেছে। রাজ্যে সরকার বদলে যাওয়ায় শুনানির সময় তৃণমূল সরকারের তরফে বাম সরকারের কোনও সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করা হয়নি। রাজ্যের আইনজীবীই ক্যাবিনেট নোট দেখিয়ে বলেছেন, টাটারা আগে থেকেই জমি চিহ্নিত করে রেখেছিল। আজকের রায় শুনানির মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
রায় শুনে টাটা মোটর্সের এক মুখপাত্র বলেন, ‘‘আজ আদালত যে মামলায় রায় দিয়েছে, সেটি টাটা মোটর্সকে লিজ দেওয়ার আগে রাজ্য সরকারের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলা। ২০১১ সালের সিঙ্গুর আইন সংক্রান্ত আমাদের মামলার এখনও শুনানিই হয়নি। এ বিষয়ে আর কিছু বলার আগে রায় খতিয়ে দেখতে হবে।’’ যদিও আইনজীবীরা মনে করছেন, ২০১১ সালে সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়া সংক্রান্ত মমতার আইন বা সেই সংক্রান্ত মামলার আর কোনও প্রাসঙ্গিকতাই থাকছে না। রায় ঘোষণার পরেও টাটাদের আইনজীবী গোপাল জৈন বিচারপতিদের জানান, অন্য কিছু মামলায় সুপ্রিম কোর্টই এই জমির হাতবদলের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে রেখেছে। তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বিচারপতি ভি গোপাল গৌড়া বলেন, ওই সব মামলা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। তবে সিঙ্গুরে কারখানা হলে যে শিল্পক্ষেত্রে রাজ্যের ছবি ভাল হতো, তা মেনেছেন বিচারপতিরা।
সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ কেন অবৈধ, সে বিষয়ে বিচারপতিদের মতভেদ রয়েছে। ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তাঁরা। বিচারপতি মিশ্র বলেন, গোটা প্রক্রিয়াটাই ভুলভ্রান্তির ফলে বিষিয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের আপত্তি শোনা হয়নি। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ মেটানো হয়নি। তা ছাড়া টাটারা সানন্দে ন্যানো গাড়ির কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। টাটাদের কাছেও ওই জমির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। ফলে কৃষকদের জমি ফেরানো হোক।