মায়ের সঙ্গে শুভজিৎ।— নিজস্ব চিত্র
প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন বাবা। সংসার চালানোর জন্য মাকে নিতে হয়েছে আয়ার কাজ। তাঁর রোজগারের হাজার চারেক টাকাই এখন চার জনের পরিবারটির ভরসা।
টানাটানির সংসারে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরু করেছিল দশম শ্রেণির ছাত্রটি। কিন্তু পরীক্ষার সময়েই আচমকা এসে পড়ল অন্য এক বাধা। আইসিএসই পরীক্ষার দিন সাতেক আগেই পরিবারটিকে শুইয়ে দিল ‘চিকেন পক্স’ বা জলবসন্ত।
শিক্ষকেরা ভেবেছিলেন, লড়াইটা বোধ হয় শেষ হয়ে গেল রাজপুরের শুভজিৎ দে-র। কিন্তু কোনও বাধাই আটকাতে পারেনি ছেলেটিকে। সোমবার ফল বেরোনোর পরে দেখা গেল, শুভজিৎ পেয়েছে ৯০.৯৮ শতাংশ নম্বর। শুনে চোখের জলে ভাসলেন শুভজিতের মা অর্চনাদেবী। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মা বললেন, ‘‘একটি দুর্ঘটনায় পড়ে ওর বাবা শয্যাশায়ী। পরীক্ষার সময় আমরা সকলেই চিকেন পক্সে পড়ি। অসুস্থ শরীরেই বাবা-মা-বোনের জন্য ভাত রান্না করে তবে পরীক্ষা দিতে যেত ছেলেটা।’’ কুঁদঘাটের যে-স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ছেলেটি, সেই মনসুর হাবিবুল্লাহ স্মৃতি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখেও তৃপ্তির হাসি।
পরিবারের আর্থিক টানাটানির কথা জেনে স্কুল-কর্তৃপক্ষ সাহায্যের হাত না-বাড়ালে যে পড়া ছেড়ে দিতে হত, এ দিন বারে বারেই সে-কথা বলেছে শুভজিৎ। সে জানায়, বছরের পর বছর বই-খাতা থেকে শুরু করে পোশাক— সবই জুগিয়েছেন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। স্কুলের অধ্যক্ষা প্রতুলা রায়ও বলেন, ‘‘মেধাবী ছেলেটির পড়াশোনা টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা আমরা হতে দিইনি। কিন্তু চিকেন পক্স হওয়ায় আমরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ওর জন্য আমাদের গর্ব হচ্ছে।’’
শুধু শুভজিৎ নয়। দুরন্ত জেদ নিয়ে লড়াই চালিয়ে বিজয়ী হওয়ার তালিকায় রয়েছে আরও অনেক নাম। যেমন, সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির (আইএসসি) পরীক্ষার্থী ঈপ্সিতা অধিকারী প্যানক্রিয়াটাইটিস-এর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই পরীক্ষায় বসেছিলেন। শারীরিক প্রতিকূলতাকে জয় করে তাঁর নম্বর ৯৭ শতাংশ। একই ভাবে লক্ষ্যে অবিচল থেকে লড়াই চালিয়ে সফল হয়েছে রামমোহন মিশন স্কুলের আইসিএসই-র সৌম্যজিৎ সাহা, মেঘনা দাশগুপ্তের মতো অনেকে।
আইসিএসই, আইএসসি-তে এ বার বাংলার জয়জয়কার। গোটা দেশকেই চমকে দিয়েছেন জোকার বিবেকানন্দ মিশন স্কুলের অর্ক চট্টোপাধ্যায় এবং সেন্ট জেভিয়ার্সের সৌগত চৌধুরী। অর্ক আইএসসি-তে দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছেন। তাঁর নম্বর ৯৯.৭৫ শতাংশ। সৌগতও আইসিএসই-তে দেশের প্রথম। শতাংশের হিসেবে তাঁর নম্বর ৯৯.২।
তাঁদের সাফল্যের চাবিকাঠি কী?
সাফল্যের হাসি। সারা দেশে আইএসসি-তে প্রথম অর্ক চট্টোপাধ্যায় (৯৯.৭৫%) (বাঁ দিকে)
এবং আইসিএসই-তে প্রথম সৌগত চৌধুরী (৯৯.২%) সোমবার এবিপি আনন্দের দফতরে।
বেহালার শকুন্তলা পার্কের বাসিন্দা অর্ক বললেন, ‘‘আমি দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পড়তাম। তবে পড়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় ছিল না। এতটা নম্বর যে পাব, সেটাও ভাবিনি।’’ বাবা-মায়ের কাছ থেকে কেমন সাহায্য পেয়েছেন? জবাব দিলেন অর্কের মা মণিদীপাদেবী। বললেন, ‘‘আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করি। তাই ছেলেকে বেশি সময় দিতে পারিনি। ভারতসেরা হবে, এতটা ভাবিনি!’’
ছেলের কৃতিত্বে চমৎকৃত সল্টলেকের সৌগতের বাবা শুভাগত চৌধুরীও। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট শুভাগতবাবু বললেন, ‘‘ও আজ আমাদের যা দিয়েছে, তার কোনও তুলনাই হয় না। ছেলে রাতারাতি আমাদেরও সেলিব্রিটি করে দিয়েছে। পরীক্ষার সময় দিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টা করে পড়েছে ও।’’
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?
অর্ক বললেন, ‘‘আইআইটি-র পরীক্ষায় বসছি। দেখি, কী হয়! পদার্থবিদ্যা নিয়েও পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে।’’ আর সৌগত বলেছে, ‘‘আমি বিজ্ঞান ভালবাসি। বিজ্ঞান নিয়েই এগোব।’’
এক জন দশম শ্রেণির পরীক্ষায় প্রথম, অন্য জন দ্বাদশ শ্রেণির। এ দিন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এসে মুখোমুখি হয়েছিলেন সৌগত আর অর্ক। সৌগত জানতে চাইল অর্কের কাছে, ‘‘আচ্ছা, আইসিএসই-র থেকে আইএসসি বেশ কঠিন না!’’ মৃদু হেসে অর্কের মন্তব্য, ‘‘না, তেমন কিছু না। একটু ভাল করে পড়লেই হবে।’’
এরই মধ্যে অর্ককে ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্ক বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। তিনি বললেন, আনন্দের মুহূর্ত বাবা-মায়ের সঙ্গে উদ্যাপন করতে। ভাল থাকতে।’’ আইসিএসই, আইএসসি-র সফল পরীক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও।