—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দু’টিই সরকারি নথি। একটি ময়না তদন্তের রিপোর্ট, আর একটি সিজার তালিকা। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে এই দুই নথিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, একটি নথির বয়ান মিলছে না অন্যটির সঙ্গে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘মৃতার নিম্নাঙ্গের পোশাক মেলেনি’। সিজার তালিকায় আবার লেখা হয়েছে, শুধু মাত্র নিম্নাঙ্গের পোশাকই সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখানে ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকের উল্লেখই নেই। অথচ ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরি হয়েছে মৃতদেহ উদ্ধারের দিন, ৯ অগস্ট সন্ধ্যায়, আর সিজার তালিকা পুলিশ তৈরি করেছে ওই রাতেই পৌনে ১১টার আগে!
এই ‘পোশাক রহস্য’ নতুন করে সামনে আসায় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, সন্ধ্যায় ময়না তদন্তের সময়ে যা পাওয়া গেল না, রাতেই কী করে তা সিজার তালিকায় উঠে গেল? তবে কি কিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছিল? সোমবার সুপ্রিম কোর্টেও ময়না তদন্তের রিপোর্টে অসঙ্গতি নিয়ে সরব হন আইনজীবীরা। তাঁদের প্রশ্ন, মৃতার পোশাকের উল্লেখ ময়না তদন্তের রিপোর্টে যথাযথ ভাবে করা হয়নি কেন? তবে কি নমুনা সংগ্রহে এবং ময়না তদন্তে গলদ ছিল? সিবিআইয়ের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দাবি করেছেন, ‘‘তদন্তে এই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে।’’
দেখা যাচ্ছে, ওই ময়না তদন্তের রিপোর্টে মৃতদেহের ‘এক্সটার্নাল অ্যাপিয়ারেন্স’ বা ‘বাহ্যিক চেহারার বিবরণে’ লেখা হয়েছে, অন্তর্বাস-সহ ঊর্ধ্বাঙ্গের সমস্ত পোশাকের বিবরণ। সেখানেই লেখা, ‘লোয়ার গার্মেন্টস মিসিং’ অর্থাৎ নিম্নাঙ্গের পোশাক মেলেনি। প্রসঙ্গত, ময়না তদন্তের এই রিপোর্টেই উল্লেখ, গত ৯ অগস্ট মৃতদেহ উদ্ধারের দিন ময়না তদন্ত করা হয়েছে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট থেকে ৭টা ১০ মিনিটের মধ্যে। এখানেই উঠে আসছে সিজার তালিকার প্রসঙ্গ। যেখানে লেখা হয়েছে, ৯ অগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।আর জি কর হাসপাতালের চতুর্থ তলের সেমিনার রুম থেকে যা যা ‘উদ্ধার হয়েছে’, তা লেখা হয়েছে এই তালিকায়। তবে দেখা যাচ্ছে, তালিকার ৪০টি ‘সিজার আইটেমে’র কোনওটিই মৃতার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক নয়। শুধু ১২ নম্বর ‘সিজার আইটেম’ হিসেবে একটি নীল রঙের জিনস এবং নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস উদ্ধারের কথালেখা রয়েছে।
ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের দাবি, পোশাকের পরীক্ষা ময়না তদন্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পোশাক থেকে যে ধারণা পাওয়া গেল, ময়না তদন্তের পরে রিপোর্ট লেখার সময় সেটা মিলিয়ে দেখে এগোন চিকিৎসকেরা। ধর্ষণের মতো ঘটনায় পোশাকের অবস্থা পরীক্ষা করা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ময়না তদন্তকারীদের সামনে অনেক নতুন সূত্র তুলে ধরতে পারে নিম্নাঙ্গের পোশাক। এ ক্ষেত্রে নিম্নাঙ্গের পোশাক ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকেরা পাননি বলেই কি ময়না তদন্তের রিপোর্টে নিম্নাঙ্গের আঘাত বা অন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের স্পষ্ট উল্লেখ করা নেই? নিম্নাঙ্গের পোশাকে যে সেমিনাল ফ্লুইড পাওয়ার কথা, সেটা না পেয়েই কি ধর্ষণের কথা সরাসরি বলা হয়নি ময়না তদন্তের রিপোর্টে? সূত্রের দাবি, এই দিকটি আলাদা করে তদন্ত করে দেখছে সিবিআই।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও সোমবার জানতে চান, কোনও দেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানোর আগে যে চালান লেখা হয়, সেটা এ ক্ষেত্রে হয়েছিল কি? প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, ওই চালানেই মৃতার সমস্ত কিছুর বিবরণ থাকার কথা। তিনি কী পোশাক পরে ছিলেন এবং সেগুলি কী অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে সেই কথাও ওই চালানে লেখা থাকার কথা। তবে রাজ্য সরকারের আইনজীবী বা সিবিআই— কোনও পক্ষই সেই চালানের কাগজ আদালতে দেখাতে পারেননি। যদিও সিবিআই সূত্রে দাবি, চালান লেখা না হলেও কলকাতা পুলিশ এক ধরনের রিকুইজিশন লিখে মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠায়। এ ক্ষেত্রেও টালা থানার এক জন সাব ইন্সপেক্টর আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষকে একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন। তাতে ‘বিশেষ কারণে’ ময়না তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হলেও মৃতার পোশাকের কোনও বিবরণ লেখা নেই বলে সিবিআই সূত্রের দাবি।
অবসরপ্রাপ্ত ফরেন্সিক চিকিৎসক অজয় গুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ব্রিটিশ আমল থেকে চালান লিখে ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো নিয়ম। পরে ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর-এর ১৭৪ নম্বর ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিধানে কী কী পাওয়া গিয়েছে, সব লিখে চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর কথা পুলিশের। বহু ক্ষেত্রেই পুলিশ নিজের মতো নিয়ম তৈরি করে নিচ্ছে দেখছি। এ ক্ষেত্রে আবার ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক নিম্নাঙ্গের পোশাক পেলেন না, অথচ, সিজার তালিকা তৈরি করা পুলিশ অফিসার পেয়ে গেলেন! গাফিলতির আর কোন কোন নিদর্শন দেখতে হবে, ভেবে পাচ্ছি না।’’