—প্রতীকী ছবি।
এসে গেল ফসল তোলার সময়। ধান, আলু কিংবা সর্ষে নয় — ভোট। চাষির দানে কি নবান্ন হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের?
চাষির ক্ষোভের ঢেউয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। তখনও কৃষির উন্নতি বলতে দিল্লি বোঝে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি। সেই সময়ে— ২০১১ সালে— মমতা জোর দিলেন চাষির রোজগার বৃদ্ধিতে। দু’টি প্রধান কৌশল নিলেন। এক, কৃষক বাজার নির্মাণ শুরু করলেন। দুই, বেশি করে ধান কেনার নির্দেশ দিলেন।
প্রথম কয়েক বছরে ১৮৬টি কৃষক বাজার তৈরি করেছিল রাজ্য। তার পরে আর তেমন করেনি। জমির অভাব। আর কী-ই বা হবে আরও বাজার করে? গোটা পঞ্চাশেক বাজার তো কার্যত ‘ভূতের বাড়ি’ হয়ে থাকল। অধিকাংশ মান্ডিতে সরকারি ধান কেনা ছাড়া অন্য লেনদেন হয় না। মালদহের সামসি বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের মতো গোটাকতক মান্ডি জমজমাট হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সরকারি মান্ডির পাইকারি দাম প্রায়ই কম থাকে খোলা বাজারের চাইতে। তবু বেশ কিছু বাজারের পরিকাঠামোর উন্নতি হওয়ায় মাল বাছাই, প্যাকিং, পরিবহণে সুবিধা হয়েছে। হাট আর বেসরকারি বাজারের অবস্থা তথৈবচ। তবে বেসরকারি বাজারে বিক্রিকে বৈধ করে আইন, সব বাজারে ব্যবসার একটিই লাইসেন্স চালু করা, কৃষিপণ্যবাহী ট্রাকের টোল মকুব, গ্রামীণ রাস্তার উন্নতি— এগুলি কৃষি বিপণনে সাহায্য করেছে।
সরকারি ক্রয় বেড়েছে। ২০১১ সালে ২০ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। এ বছর কিনবে ৫২ লক্ষ টন। ন’বছরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি বেড়েছে কুইন্টালে প্রায় ৭০০ টাকা। এত টাকার কতটুকু ছোট চাষি পাচ্ছেন, প্রতি বছর সেই প্রশ্নে কাঁপে অগ্রহায়ণ-পৌষের দিনগুলো। সরকারি মান্ডি দখল করেছে চালকল মালিক আর ফড়েরা। চাষি ধান দিতে গিয়ে পাঁচ-ছ’মাস পরে বিক্রির তারিখ পায়। শোরগোল ওঠে— তবে কি উন্নয়নের ধান রাজনীতিতে খাচ্ছে?
চাষিকে দু’টো বাড়তি টাকার মুখ দেখিয়েছে আনাজ। আনাজের উৎপাদন বেড়ে রাজ্য এখন দেশের শীর্ষে। ভুট্টার উৎপাদন পাঁচ গুণ হয়েছে। বেড়েছে তৈলবীজ, ডালের চাষও। কিন্তু স্থানীয় বাজারের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই চাষির। তাই ফড়ে আনাজ কেনে জলের দরে। প্রচুর নষ্টও হয়। রফতানির পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। কৃষিজাত শিল্প তেমন গড়ে ওঠেনি। যা ছিল বাংলার গর্ব, সেই পাটশিল্প ধুঁকছে। পাটচাষের জমি কমেছে গত এক দশকে, একর-প্রতি উৎপাদনও বাড়েনি। শিল্পের দুর্দশা ছায়া ফেলছে চাষির রোজগারেও।
চাষির রোজগার কত? পশ্চিমবঙ্গে এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। রাজ্যের দাবি, চাষির গড় রোজগার বছরে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। মানে, মাসে ২৪ হাজার টাকার মতো। জাতীয় সংস্থা নাবার্ড তার সমীক্ষায় (২০১৮) বলছে, বাংলার চাষির গড় মাসিক আয় বড়জোর ৭ হাজার টাকা। এই হিসেব মানতে নারাজ রাজ্য। আবার, বিরোধীরা মানতে নারাজ রাজ্যের দাবি যে, পশ্চিমবঙ্গে চাষি-আত্মহত্যার সংখ্যা শূন্য (২০১৯)।
চাষির সুরক্ষায় মমতার লক্ষণীয় উদ্যোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ তহবিল থেকে চাষিকে দ্রুত অনুদান। আট বছরে ৩,৩০০ কোটি টাকা পেয়েছেন চাষিরা। সেই সঙ্গে ধান-সহ বেশ কিছু ফসলের বিমার প্রিমিয়াম সম্পূর্ণ বহন করছে রাজ্য। এই মুহূর্তে যত চাষি এসেছেন বিমার অধীনে, রাজ্যের ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব।
এখনও কৃষিঋণ পান না অধিকাংশ চাষি। ঠিকাচাষে ক্রমিক বৃদ্ধি যার অন্যতম কারণ। তবে রেশন ব্যবস্থার প্রসার, একশো দিনের কাজে গতির জন্য চাষির পেট চালানোর জন্য ঋণ নেওয়ার ঝোঁক কমেছে। ভিন্ রাজ্যে মজুরিও চাষি পরিবারের নিরুপায় দশা কমিয়েছে।
মোটের উপর, মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি নীতি তাঁর অন্যান্য নীতির মতোই। প্রকল্পের মাধ্যমে অনুদান বিতরণে দরাজ, কিন্তু সংস্কারে অনাগ্রহী। কৃষির কারবারে নানা অপচয়, অন্যায্যতাকে সংশোধন করে, কৃষি আইন পরিবর্তন করে, বাজারকে ছোট চাষির অনুকূল করায় আগ্রহী নয় তাঁর সরকার। বাম আমলের ফড়ে-রাজ তৃণমূল আমলে বিন্দুমাত্র কমেনি। তাই খেতে ধানের দাম পড়ে, আর বাজারে আলুর দাম চড়ে।