এসএসসি দুর্নীতি মামলায় ২৩ জুলাই, শনিবার রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী (বর্তমান শিল্পমন্ত্রী) পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করেছে এনফেোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এর আগে পার্থকে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ পাওয়ার ইস্তক ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিবিআই। স্কুলশিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে পার্থের নাম আদালতে উঠে আসে গত এপ্রিল মাসে।
এসএসসি-র গ্রুপ ডি এবং নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ মামলায় চলতি বছরের গত ১২ এপ্রিল প্রথম বার পার্থকে সিবিআই হাজিরার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, পার্থকেও নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের দফতরে হাজির হতে হবে। তাঁর আরও সংযোজন, হাজিরা এড়াতে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হতে পারবেন না পার্থ। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে মন্ত্রীকে গ্রেফতার করার ছাড়পত্রও সিবিআইকে দিয়েছিল আদালত।
ঘটনাচক্রে, বিচারপতির এই নির্দেশের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ১১ এপ্রিল রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছিলেন, ‘‘এসএসসি দুর্নীতির ঘটনায় সরাসরি যুক্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায়।’’
যদিও ১২ এপ্রিল সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে হয়নি পার্থকে। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চের নির্দেশের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেয় বিচারপতি সুব্রত তালুকদার ও বিচারপতি আনন্দকুমার মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। তার পর দিনই একক বেঞ্চের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়িয়ে পাঁচ সপ্তাহ করা হয়।
পাঁচ সপ্তাহের মেয়াদ শেষে গত ১৮ মে পার্থকে আবার সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্টের একক বেঞ্চ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানান, তাঁর আশা, মন্ত্রিপদ থেকে শীঘ্রই সরে দাঁড়াবেন পার্থ। একক বেঞ্চের এই নির্দেশের পর সিবিআই দফতরের হাজিরা এড়াতে আবার ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়েছিলেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চ ওই আবেদন শুনতে চায়নি।
ডিভিশন বেঞ্চ আবেদন গ্রহণ না করায় শেষমেশ বাধ্য হয়ে ১৮ মে প্রথম বার সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে হয়েছিল পার্থকে। তদন্তকারীদের মুখোমুখি হওয়ার কিছু আগেই প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের কাছে দ্রুত শুনানির আর্জি জানিয়েছিলেন পার্থের আইনজীবীরা। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়নি।
১৮ মে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সিবিআই দফতরে ছিলেন পার্থ। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়েই গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন মন্ত্রী।
পরে ২০ মে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পার্থকে দ্বিতীয় বার তলব করে সিবিআই। ওই দিনই হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে রক্ষাকবচের আবেদন করেছিলেন পার্থের আইনজীবীরা। যদিও সেই আবেদন খারিজ করে আদালত। বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি আনন্দকুমার মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, প্রয়োজনে পার্থকে নিজেদের হেফাজতে নিতে পারে সিবিআই।
এর পর গত জুন মাসে স্কুল সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বেআইনি লেনদেন সংক্রান্ত যে সব অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখতেই তদন্তে নামে ইডি।
সাধারণত কোথাও বড় অঙ্কের টাকা নয়ছয়ের ইঙ্গিত মিললে, সেখানে সিবিআইয়ের সঙ্গে তদন্তে নামে ইডি। এ ক্ষেত্রেও নিয়োগ ঘিরে টাকা হাতবদলের যে অভিযোগ উঠেছে, তা কোথা থেকে এল, তার অঙ্ক কত, এবং শেষ পর্যন্ত তা কোথায় আর কাদের হাতে পৌঁছেছে— মূলত এ সবই খতিয়ে দেখা শুরু করে তদন্তকারী সংস্থা।
২২ জুলাই, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ হঠাৎ পার্থের বাড়িতে চলে যান ইডির আধিকারিকেরা। বেলার দিকে তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন পার্থ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে সূত্রের খবর। সেই সময় তাঁর চিকিৎসার জন্য ভবানীপুর থানার পুলিশের সঙ্গে এসএসকেএমের তিন জন চিকিৎসক এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে। এক জন অস্থি বিশেষজ্ঞ, এক জন মেডিসিন এবং এক জন কার্ডিয়োর চিকিৎসক ছিলেন।
শুক্রবার রাত থেকেই মন্ত্রীর বাড়ির সামনে ইডি আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। ভোর হতে হতে তদন্তকারীদের আরও একটি দল সিজিও কমপ্লেক্স থেকে পার্থের বাড়ি চলে আসে। বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় বাহিনী।
বহু জল্পনার আবহে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ২৬ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদের পর পার্থকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। প্রসঙ্গত, শুক্রবার পার্থের বাড়ি ছাড়াও আরও ১৩টি জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। তার মধ্যে ছিল রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেখলিগঞ্জের বাড়ি, এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন আহ্বায়ক শান্তিপ্রসাদ সিংহ, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য, পর্ষদ সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচীর বাড়ি। এ ছাড়াও ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায় নামে এক মহিলার ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে শুক্রবার রাতেই ২১ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে ইডি।
শনিবার পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁকে জোকা ইএসআই হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
মেডিক্যাল পরীক্ষার পর পার্থকে ৩টে নাগাদ ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির করানো হয়।