প্রতীকী ছবি।
কলাপাতায় স-ফেন গরম ভাত, একটু গাওয়া ঘি, দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে শাক! বৌ বেড়ে দিচ্ছেন, আর পুণ্যবান খাচ্ছেন! বাঙালির ৭০০ বছর আগের প্রাকৃতপৈঙ্গল কাব্যের বহুচর্চিত শ্লোক বলছে, গেরস্তের জীবনে সুখ বলতে আর কী!
গড়িয়াহাট বাজারের সর্বজনবিদিত মাছওয়ালা ভুতোদা ওরফে ভূতনাথ ঘোষ ভরদুপুরে আঁচিয়ে বললেন, ‘‘রাতে তেল, গ্যাসের খরচ বাঁচাব, দুধরুটি খাব! এ বেলা ফাসক্লাস কুমড়োর তরকারি আর মৌরলার ঝাল খেলাম!’’
ইদানীং কালে এটাই রাজভোগ! নিজে মাছ বিক্রি করেও এখন ট্যাংরা, ভেটকি, পার্শে খেতে গায়ে লাগে ভূতোবাবুর! আনাজ মানেও আলু আর আলু। মৌরলারও ৪০০-৫০০ টাকা কেজি। তবু ছোট মাছ, অল্পস্বল্প পাতে পড়লেই গন্ধে খাওয়া হয়!
বনগাঁ লাইনে গোপালনগরের আনাজ চাষি শীতল প্রামাণিকের বাড়িতেও ভাতের সঙ্গে একটা আলুপটলের ঝোলই পরম সুখ! রোজরোজ ভাজা বা ডালের বাবুয়ানি বন্ধ! ৯১১ টাকার গ্যাস সিলিন্ডার, ২০০ টাকা কেজি সর্ষের তেলের বোঝা কি সোজা কথা ? প্রাক-গ্যাস সিলিন্ডার যুগে শুধু সর্ষেকে নিয়েই কাব্যি করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়!
অ-পূর্ব বঙ্গভূমি! সর্ষের তেল নাকে দিয়ে ঘুমিয়েছিলে তুমি! সর্ষের ফুল দেখছ চোখে মূল্য আকাশচুমী।
শুনলে মনে হয় আজকেই লেখা হয়েছে। অতিমারি, মূল্যবৃদ্ধি, কর্মহীনতায় জীবন সঙ্গিন। তবু সে-কালের মতো ‘দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যদি পাই, তবে তার মতো আর কিছু নাই’ বলে কাউকে বৃন্দগীতির আদলে ছন্দ মেলাতে হয়নি! কিন্তু গোপালনগরের শীতলবাবু বা নদিয়ার বাদকুল্লার সোমেশ্বর শিকদার মশাইয়ের মতো আনাজগাড়ির ভেন্ডর বোঝেন, রেশনের নিখরচার চাল বা গরিবের জন্য দু’টাকার চাল, আটা আছে তাই রক্ষে! নইলে উপোস করেই মরতে হত। কিন্তু শুধু ভাতও খাওয়া যায় না! পশ্চিমবঙ্গ ভেন্ডর সংগঠনের সভাপতি, কোলে মার্কেটের কমল দে বলেন, “চাষিদের যা অবস্থা, তাতে আনাজের দাম খুব চড়া হয়েছে বলতে পারি না! কিন্তু সাধারণ গৃহস্থের ওইটুকু খাওয়ারই সঙ্গতি নেই! তাই চাহিদা তলানিতে। রাজ্যে পাঁচ, ছ’কোটি লোক জ্যোতি আলুতেই চালিয়ে নিচ্ছে।”
তেতাল্লিশের মন্বন্তর, দেশভাগের কলকাতায় বালিগঞ্জের বাসিন্দা এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্তা, বাঙালিবাবুর কয়েক বছরের হিসেবের খাতা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছিলেন তাঁর উত্তরপুরুষেরা। তাতে দেখা যাচ্ছে, ইংরেজিতে লেখা রোজকার হিসেবে কোনও অস্থিরতা বা আশঙ্কার লক্ষণ নেই। গড়িয়াহাট বাজার থেকে রোজকার মাছ, আনাজ, দুধ, দই, সন্দেশ বা কলাটার জোগান দিনের পর দিন, একই থেকেছে। কোলে মার্কেটের কমলবাবুদের হিসেবে, এখনও দশ শতাংশ লোকের জীবন তেমনই নিস্তরঙ্গ। আর সমাজের একেবারে তলানিতে থাকা ১০-২০ শতাংশেরও সবই সয়ে যায়। যত জ্বালা বিত্তমধ্য স্তরেই।
কিছু অভ্যেস মরেও মরে না! এই তো সেদিন মেয়ের জন্মদিনে উল্টোডাঙার মুচিবাজারে সাদা কচি ফ্যান্সি পটলের গায়ে হাত বুলিয়ে চোখটা চকচক করছিল ভাড়ার গাড়ির চালক সঞ্জীব ওঝার! যেন গত জন্মের ইশারায় ডাকছে, কত কাল অদেখা সাদা লুচি আর মাংসল কোমল পটলভাজা! মাস গেলে ১৮-২০ হাজার টাকা রোজগার একেবারে শূন্যে ঠেকেছিল সঞ্জীবের। একটা ছোট অফিসে কিছু অ্যাকাউন্টসের কাজ আর ড্রাইভারি মিলিয়ে ৮-১০ হাজার হচ্ছে। এ সময়ে গ্যাস পুড়িয়ে এমন বিলাসিত পোষায়! রোজকার আলু ভাতে, আলু ভাজা, আলু চচ্চড়ির ছক থেকে বেরিয়ে শেষমেশ মেয়ের জন্য একটু কাতলা মাছের ঝোলের সংস্থান করাই শ্রেয় মনে হল।
খরচ বাঁচাতে এক পদের মেনুতে অনেকেই এখন আনাজবিমুখ। শিলিগুড়ি, ধূলাগড় বা কোলে মার্কেটে ছয়, ছয় বারো টনের দু’টো লরি বোঝাই আনাজপাতি নিয়ে যাঁরা আসতেন, তাঁরা বড়জোর একটি গাড়ি আনছেন। লাইন হোটেলগুলোতেও খদ্দের কম! তাই বিক্রি ধাক্কা খাচ্ছে। গড়িয়াহাটের ভূতোদার হা-হুতাশ, আগে শিয়ালদহ থেকে আনা ৩০-৩৫ কেজি মাছ দেড় দিনে উবে যেত। এখন পাঁচ দিন পড়ে থাকছে! বরফেরও বাড়তি খরচ।
পেট্রলের দামের শতক স্পর্শের আঁচও পড়ছে রোজকার ভাতপাতে। এই অসময়ে বেঙ্গালুরু, হিমাচলের ফুলকপি, উত্তরপ্রদেশের বড় মসুর, ওড়িশার বিউলি বা কাশীর আটার দামও ঊর্ধ্বমুখী। সর্ষের তেল অধরা! অফিসপাড়ায় পাম অয়েলের তেলেভাজা খেয়ে মুখ ব্যাজার বাঙালির! এ সবের মধ্যে চেষ্টা আলুনি জীবনে স্বাদ সঞ্চারের। চুঁচুড়া থেকে কলকাতায় মিষ্টির হকারি করা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ফি-রবিবার দুই কন্যেকে চমকে দিতে দশ টাকার লাল শাক নিয়ে আসেন। একটু বাদাম ছড়িয়ে দেন তাতে। সঙ্গে একটু লঙ্কাচেরা চারাপোনার ঝোল! তবু আফসোস, পোস্তর দরটা নিক্তিতে সোনা কেনার মতো হয়ে গেল যে! শাক বা মাছের ঝোল, দুটোই একটু পোস্ত ছিটোলে অন্য রকম হয়! পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রদীপের মনে পড়ে, খাওয়াদাওয়া নিয়ে বরাবরই নাক উঁচু তাঁদের পরিবারে ১৯৮০-র দশকেও মাসে তিন কেজি পোস্ত উড়ে যেত। এই দুর্দৈবে এক সঙ্গে বাঁচার গুষ্টিসুখ কত না স্বাদ-স্মৃতি ছুঁয়ে ভরে ওঠে।