মা সারদা।
“ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল। সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্য আমাকে এবার রেখে গেছেন।” শ্রী শ্রী মায়ের নিজমুখের এই ঘোষণায় ‘মা’ তাঁর বিশ্বমাতৃত্বের অঙ্গীকার করে গিয়েছেন জগতের মানবের কাছে।
এই যুগ সর্বসাধারণের যুগ। একই শক্তি ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য সকল দ্বন্দ্বের জন্মদাত্রী, পালয়িত্রী। এই শক্তিরই এক রূপ মা সারদা। তাই মায়ের মধ্যে মানবতাবোধ পূর্ণ রূপে বিকশিত। তাই দেখি তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ কোনও বাধাই সৃষ্টি করতে পারেনি। মুসলমান ডাকাত ‘আমজাদ’ এবং ঠাকুরের ত্যাগী সন্তান ‘শরৎ’ তাঁর কাছে সমান। আবার ভারতকে পদানত করে রেখেছে যে ইংরেজ তারাও তাঁর সন্তান, তাঁদেরও কল্যাণ কামনা করেন তিনি। এই তো প্রকৃত মানবধর্ম। সমাজের তৈরি, মানুষের তৈরি সব রকম ক্ষুদ্র গণ্ডি ভেঙে ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন ‘গণ্ডিভাঙা মা’। নিজের অধিকার, নিজের প্রাপ্য অনায়াসে সকল মানুষের জন্য ছেড়ে দিয়ে ঠাকুরকে পর্যন্ত বলেছিলেন, “...তুমি তো শুধু আমার ঠাকুর নও— তুমি সকলের।” এই যে নিজেকে ছাপিয়ে মানুষের জন্য ছড়িয়ে পড়া— এই বিরাট ভাবের কাছে ঠাকুর পরাজয় স্বীকার করেছেন সানন্দে এবং স্বেচ্ছায়।
এক দিন মাকে উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে দেখে মায়ের ভাইঝি নলিনীদি বললেন, “মাগো, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়ুচ্ছে!” মা শুনে বললেন, “সব যে আমার, ছত্রিশ কোথা?” অর্থাৎ মানুষের একটাই জাত— সে মানুষ তাঁর নিজের সন্তান। এখানে দেখি মা সারদার পরবর্তী প্রজন্মও যে উদারতা দেখাতে পারেনি, মায়ের মানবতাবোধ তাকে স্পর্শ করতে পারছে। সমাজের চোখে হয়ে এবং ঘৃণিত ব্যক্তিরাও নিঃসঙ্কোচে যেতেন মায়ের কাছে। তাঁর উদার মানবতাবোধ মানুষের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে মানুষের প্রকৃত মঙ্গল করতে ব্যগ্র ছিল। যখন এমন এক জন ব্যক্তির দেওয়া জিনিস ঠাকুরকে দিতে মানা করলেন জনৈক স্ত্রীভক্ত, তখন মা বললেন, “দোষ তো মানুষের লেগেই আছে। কী করে যে তাকে ভালো করতে হবে, তা জানে কজন!”
একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে জগৎ আজ দিশাহারা! এক দিকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এনেছে চোখ ঝলসানো ভোগের উপকরণ ও অত্যন্ত আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য বিশ্বায়ন। কিন্তু ভিতরের চিত্রটি বড়ই করুণ! সেখানে বেড়েছে হিংসা, হানাহানি। বেড়েছে মানুষে মানুষে দূরত্ব। মানুষ আজ জাগতিক বিষয়ে অনেক কিছু জানে। বেড়েছে ‘ইন্টেলিজেন্ট কোশেন্ট’ বা বুদ্ধিমত্তা। কমেছে হৃদয়বত্তা; কমেছে মহতের প্রতি টান, অনুরাগ। আজকের সমাজে এতটাই ফাঁকা আড়ম্বর যে মানুষ ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে গেলেও বাইরের চাকচিক্য দিয়ে সেই দৈন্য ঢাকতে চায়। তীব্র গতিময় জীবনের ভীষণ বেগে মানুষ যতই ঘুরছে ততই সে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। তাই অন্তরে সে খুঁজছে শান্তির ক্রোড়। মানুষ আজ বড় দুঃখী! নীড়হারা মানুষ আজ খুঁজছে নিশ্চিন্ত শান্তির আশ্রয়— মায়ের কোল। দেশকালের দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে বিরাজমানা চিরন্তন মাতৃশক্তি— মা সারদা। মানুষ আজ তাঁর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে নিশ্চিন্ত মানস-আশ্রয়। মায়ের অপার স্নেহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দোষ-গুণের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে— স্পর্শ করেছে মানবধর্মের সেই উচ্চশিখর যেখানে— ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। তাই তো তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, “... কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।”