দক্ষিণের কড়চা

মাটির তাল নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় রূপ পাচ্ছে পরিপাটি পুতুলে। আগুনে পুড়ে পুতুল হচ্ছে আরও পোক্ত। তার গায়ে লাগছে গালায় মেশানো রঙের পোঁচ। নানা রঙের গালার সুতো গায়ে জড়িয়ে পুতুল পাচ্ছে অনুপম রূপ। বাবা-মায়ের থেকে এই গালার পুতুল তৈরির কলা শিখেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরের বাসিন্দা বৃন্দাবন চন্দ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০০:৫২
Share:

গালার গালগল্প

Advertisement

মাটির তাল নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় রূপ পাচ্ছে পরিপাটি পুতুলে। আগুনে পুড়ে পুতুল হচ্ছে আরও পোক্ত। তার গায়ে লাগছে গালায় মেশানো রঙের পোঁচ। নানা রঙের গালার সুতো গায়ে জড়িয়ে পুতুল পাচ্ছে অনুপম রূপ।

বাবা-মায়ের থেকে এই গালার পুতুল তৈরির কলা শিখেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরের বাসিন্দা বৃন্দাবন চন্দ। তাঁদের গ্রাম খড়ুই এলাকার পশ্চিম সাঁইয়ে তখন অনেক ঘরেই চলত গালার পুতুল তৈরির কাজ। চলত আশপাশের অনেক গ্রামেই। বাবার সঙ্গে উইঢিবির মাটি নিয়ে আসতেন বৃন্দাবন। আজকের পঞ্চাশ পেরোনো প্রৌঢ় তখন শিশু। সেই উইঢিবির মাটির তাল থেকেই হত কত রংবেরঙের পুতুল। এখন গ্রামে একাই সেই শিল্প বাঁচিয়ে রেখেছেন বৃন্দাবনবাবু।

Advertisement

সম্প্রতি কলকাতায় ‘চালচিত্র অ্যাকাডেমি’ আয়োজিত কর্মশালা ‘লাক্ষাদীপ’-এ এসে সে সব কথাই বলছিলেন বৃন্দাবন। রাজ্যে মেদিনীপুর ছাড়াও পুরুলিয়াতেও গালার পুতুল তৈরি হয়। শহরে ঘর সাজানোর জন্য কিছু চাহিদা থাকলেও অনেক সময়ে যথাযথ মঞ্চের অভাবে তাঁদের মতো শিল্পীরা বিপণনের জায়গা পান না। বৃন্দাবনবাবুর আক্ষেপ, লাক্ষার দাম এখন অনেক বেড়েছে। তাল মিলিয়ে বেড়েছে পুতুল তৈরির খরচও। লাভ করতে না পেরে অনেকেই এই পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। শহরের বাজারে শিল্পকর্ম বিক্রির সুযোগ পেলে আবার হয়তো উজ্জীবিত হতে পারে এই পুতুল গড়ার শিল্প।

এর আগে নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে মুম্বই-দিল্লিও ঘুরে এসেছেন বৃন্দাবন। এ বার পঞ্চসায়রে আয়োজিত দু’দিনের কর্মশালায় তাঁর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলেন অনেকে। তার মধ্যে চিত্রপরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য থেকে বর্ধমান আর্ট কলেজের অধ্যাপক সৌরভ জানার মতো বহু জনই ছিলেন। প্রদীপ্তর মতে, চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে গ্রামবাংলার এ ধরনের শিল্পকে ব্যবহার করলে মানুষ উৎসাহ দেখাবেন সিনেমার প্রতি, সেই শিল্পের প্রতিও। কম্পিউটারের ছবি দিয়ে সৌরভ দেখান ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সংস্কৃতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে পুতুলের গড়নও বদলে গিয়েছে।

গবেষকদের একাংশের মতে, ভারতের পশ্চিম থেকে বাংলায় গালা শিল্প এসেছিল। প্রাথমিক ভাবে হাতের বালা তৈরি করতেন শিল্পীরা। পরে পুতুলের উপরে গালার ব্যবহার শুরু হয়। গ্রামবাংলার শিল্পীরা বিভিন্ন হাটে ঘুরে-ঘুরে এ সব পুতুল বিক্রি করতেন। এখন ফের শহুরে বাজারে আনতে পারলে গালার পুতুল কদর ফিরে পাবে বলে নিশ্চিত বৃন্দাবনবাবু। সেই আশাতেই যেন তিনি আজও গালার সুতো দিয়ে নকশা আঁকেন। জ্বেলে রাখেন লাক্ষা-দীপ। সঙ্গে কাজে ব্যস্ত বৃন্দাবন দাস ও কর্মশালায় তৈরি গালার পুতুলের ছবি।

বেণীপুতুলের কথা

মেয়েদের মাথার চুলকে তিন ভাগে ভাগ করে যেমন বিনুনি বা বেণী বাঁধা হয়, পুতুলেরও তেমন তিন অংশ। পোশাক দোলানো মাথা আর দু’পাশে দু’টি কাঠেপর হাত— এরই নাম বেণীপুতুল। পূর্ব মেদিনীপুরের ছোট্ট গ্রাম পদ্মতামলী থেকে এই পুতুলের উপাখ্যান তুলে এনেছেন দেবপ্রসাদ পিয়াদা। কবিয়াল গুমানি দেওয়ানকে ইতিহাস ও ব্যাখ্যা-সহ ফিরিয়ে এনেছেন সুবীর ঘোষ। কেতুগ্রামে এক শিক্ষকের বাড়ি থেকে পাওয়া মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর অনুলিপি আর আউশগ্রামের দিগনগরে মেলা একটি খণ্ডিত পুথির সচিত্র হদিসও হাজির। এই সব নিয়েই এ বারের কৌলাল। বর্ধমানের কাটোয়া থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটিতে লোকসংস্কৃতি চর্চাকার তথা সংস্থার মুখ্য উপদেষ্টা মুহম্মদ আয়ুব হোসেনকে নিয়ে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্রও রয়েছে।

শীতল বোতল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে আছে সতীশ কুম্ভকারের পোড়ামাটির কাজ৷ রাজগ্রামে দত্তদের টেরাকোটার মন্দিরটির অলংকরণ সতীশের পূর্বপুরুষদের৷ কিন্তু এ সব কেবল ইতিহাসের পাতায়৷ পাঁচমুড়া ছাড়া বাঁকুড়া জেলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুমোরপাড়াগুলির কথা মনে পড়ে ঝাঁঝাঁ রোদের দিনগুলোতে, কুঁজোর জন্য৷ ফ্রিজের রমরমার যুগেও কুঁজোর চাহিদা এখনও অটুট৷ কিন্তু সেই সাবেক কুঁজোর সঙ্গে চাই নতুন কিছু৷ তাই শালবনি, পাঁচমুড়া, তালডাংরার কুমোররা এ বার হাত দিয়েছেন মাটির বোতল তৈরিতে৷ হাল্কা বোতলগুলোর চাহিদাও বাড়ছে৷ মাটির বাদন-শঙ্খের কারিগর পাঁচমুড়ার গণপতি কুম্ভকার বললেন, ‘বোতল তো বটেই, মাটির শাঁখেরও কদর বাড়ছে৷ তবে মাটির বোতলে পুরুলিয়ার কুমোররা অনেক এগিয়ে৷’ এ দিকে বাঁকুড়ায় প্রথম এই বোতল তৈরিতে যিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন সেই বিশ্বম্ভর কুম্ভকার প্রয়াত হলেন সম্প্রতি৷

কুইজ ও কাজী

‘এমন অমৃত ফল ফলিয়াছে জলে, সাহেবার সুখে তাই ম্যাঙ্গো ফিস বলে।’ লিখেছিলেন ইশ্বর গুপ্ত। সেই ‘ম্যাঙ্গো ফিস’ আসলে কী মাছ, তা-ই জিগ্যেস করে বসেছে আট পাতার মাসিক পত্রিকা। উত্তরও দিয়েছে: তপসে মাছ। শুধু ওই একটিই প্রশ্ন নয়, জিজ্ঞাসা ওই পত্রিকার ভাঁজে-ভাঁজে। পূর্ব মেদিনীপুরের ডিমারিহাট থেকে প্রকাশিত ওই পত্রিকার নামই যে কুইজ.com। মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র থেকে প্রতি মাসে ওই ফিনফিনে প্রশ্নোত্তর ছাড়াও পুজোয় একটি এবং বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। সাম্প্রতিক সংখ্যাটি করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে।

জায়া মনোরমা

বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের ওন্দা স্টেশন লাগোয়া গ্রামটির নাম কুমারডাঙা৷ এ গ্রামেরই মেয়ে মনোরমা মিশ্র৷ ১৮৮৬-তে প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক ও সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়৷ এ বছর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মের সার্ধশতবর্ষ৷ রামানন্দের নিজের জেলা বাঁকুড়ায় তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে এখন নানা অনুষ্ঠান৷ বঙ্গবিদ্যালয়ে রামানন্দ চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক উত্তম চট্টোপাধ্যায় পটের আদলে রামানন্দের জীবন-চিত্র আঁকানোয় উদ্যোগী হয়েছেন৷ দেবদাস মিদ্যা ও আতঙ্কভঞ্জন প্রামাণিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে সুচেতনা পত্রিকার রামানন্দ বিশেষ সংখ্যা৷ লিখেছেন লীলাময় মুখোপাধ্যায়, গিরীন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, আশিস পাঠক প্রমুখ৷ মনোরমা দেবীও উপেক্ষিতা থাকেননি৷ কুমারডাঙার বাসিন্দা শিবশঙ্কর সরকারের উদ্যোগে ওন্দায় হচ্ছে তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠান৷ ওন্দা থানার কলেজটির নামও মনোরমা দেবীর নামে করার দাবি জানানো হয়েছে৷

ছিন্ন সৌমেন

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়ে গিয়েছিল তাঁর— পাথর কিংবা নুড়ির শিল্প (১৯৮৭), এবং বৃহন্নলা (১৯৮৮), মোমপরীর শিকড় (১৯৮৯)। তৃতীয় বই বেরনোর পরের বছর, ১৯৯০ সালের ২৯ মে ‘একগাছা দড়ি হাতে’ মৃত্যুর দিকে নিশ্চুপে হেঁটে গিয়েছিলেন কাকদ্বীপের সৌমেন বসু। তিনি তো জানতেনই ‘মাতাল কবির আয়ু ফেটে/ হাওড়া ব্রীজের জ্যোৎস্না নীল হ’য়ে যাবে।’ মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে তিনি লিখে যাচ্ছেন ‘উত্তরণগামী যেন দিকচিহ্ন কোথাও পড়েনি’— ‘অনিচ্ছাপদ’ নামে এক স্মরণীয় কবিতায়। কবির আত্মঘাতের পরেই সুহৃদ দেবদুলাল পাঁজার চেষ্টায় বেরিয়েছিল সৌমেনের নির্বাচিত কাব্য সংগ্রহ (শতাব্দীর মুখ)। পঁচিশ বছর পরে সেই সুহৃদেরই সম্পাদনায় ১২ মাস পত্রিকা তর্পণ করল ছিন্ন কবির।

লোকচরণ

গান লিখছেন দু’দশকেরও বেশি। রাঢ়বঙ্গ ও জঙ্গলমহলেই কেটেছে শৈশব-কৈশোর-যৌবন। সেখানকার মানুষের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ বারবার উঠে এসেছে তাঁর কলমে। তবে এ বার যে কাজ করেছেন বর্তমানে হুগলির কোন্নগরনিবাসী শিবাশিস দণ্ড, তা তাঁর জীবনে প্রথম। আর অভিষেকেই তাতে রেখেছেন সাফল্যের ছাপ। পেশাদার গায়ক আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করেছেন হাবিব তনভীরের বিখ্যাত নাটক ‘চরণদাস চোর’। শ্যাম বেনেগালের মতো পরিচালক যে নাটক থেকে ছবি বানিয়েছেন। সেই নাটকই মানভূমের লোকভাষায় অনুবাদ করেছেন মধ্য চল্লিশের শিবাশিস। সেই তর্জমার প্রশংসা করেছেন হাবিব-কন্যা নাগিনা। বস্তুত, হাবিব যে ভাবে নাটকের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি, বিভিন্ন জনজাতির সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনের বার্তা দিয়েছেন শিবাশিসও অনুবাদে সেই সুর অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। লোকসংস্কৃতির সঙ্গে, বিশেষ করে মানভূম ঘেঁষা সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক তাঁকে জোর দিয়েছে। ঝুমুর শিল্পী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছেন শিবাশিস। গান লেখার সঙ্গে সঙ্গে বেতার-দূরদর্শনে করে গিয়েছেন অনুষ্ঠান। শিশুদের জন্য কিছু নাটক লিখলেও এত বড় মাপের কাজ এই প্রথম করলেন তিনি। গত ৭ জুন কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনয়েই দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে এই নাটক। ফের ৩ জুলাই অ্যাকাডেমিতে তা মঞ্চস্থ হওয়ার অপেক্ষা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement