শ্রীকান্ত ভদ্র
বামনগাছি আছে বামনগাছিতেই।
সমাজবিরোধীদের তাণ্ডবের প্রতিবাদ করায় দিন দ’শেক আগে খুন হয়েছেন এই এলাকার কলেজ ছাত্র সৌরভ চৌধুরী। বাড়ির সামনে মদের আসর বসানোর প্রতিবাদ করায় মঙ্গলবার রাতে মারধর করা হল তাঁরই এক বন্ধুকে। সৌরভকে খুনের পরে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী মঞ্চের সামনের সারিতে ছিলেন শ্রীকান্ত ভদ্র নামে ওই যুবক। নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় শ্রীকান্ত ও তাঁর মাকে সঙ্গে করে বুধবার দুপুরেই খড়্গপুরে চলে গিয়েছেন তাঁর দিদি।
শ্রীকান্তর উপরে হামলার ঘটনায় ধরা পড়েছে মূল অভিযুক্ত আমজাদ আলি মণ্ডল-সহ দু’জন। আমজাদ আবার বামনগাছি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য হানিফ মোল্লার ভাগ্নে। তাঁর নাম করেই আমজাদরা এলাকায় দাদাগিরি করে বেড়ায় বলে অভিযোগ উঠেছে। হানিফ অবশ্য বলেন, “ও আমার ভাগ্নে ঠিকই। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার বা দলের কোনও সম্পর্ক নেই।” পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে ভালই করেছে বলে মনে করেন তিনি।
তৃণমূল নেতা এ কথা বললেও পুলিশের ভূমিকায় আস্থা রাখতে পারছেন না স্থানীয় মানুষ। সৌরভকে খুনের পরে তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন, পুলিশ-প্রশাসন-সংবাদমাধ্যমের নজর একবার সরে গেলেই ফের দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য শুরু হবে। রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়া দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে বার বারই অভিযোগ করেছেন তাঁরা। সৌরভকে খুনের ঘটনায় ধৃত মূল অভিযুক্ত শ্যামল শাসক দলের যে নেতাদের আশ্রয়ে থাকত, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সে প্রশ্ন তুলেছিলেন নিহত ছাত্রের বাবা সরোজবাবুও। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ, এখনও খুনের স্মৃতি টাটকা। ধরপাকড় চলছে। এলাকায় পুলিশের যাতায়াত আছে। তা সত্ত্বেও বামনগাছির নানা প্রান্তে সাট্টা-জুয়া-চোলাইয়ের ঠেক বন্ধ হয়নি। চোরাগোপ্তা গাঁজার চাষ হচ্ছে। এ সব পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলে দুষ্কৃতীদের এলাকা-ছাড়া করা যাবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ বললেন, “আমরা কী ভাবে বেঁচে আছি দেখুন। সৌরভের মতো আবার একজন শহিদ হতে যাচ্ছিল।”
মারধরের ঘটনায় ধৃত বিশ্বজিৎ বিশ্বাস (বাঁ দিকে) এবং আমজাদ আলি মণ্ডল।
বুধবার দু’জনকে হাজির করানো হয় বারাসত আদালতে। —নিজস্ব চিত্র
রাজ্যে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার অ্যাকাডেমির সামনে বিশিষ্ট জনেরা প্রতিবাদ সভা করেন। সেখানে হাজির ছিলেন সৌরভের দাদা-সহ ওই যুবকের খুনের পরে বামনগাছিতে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যেরা।
মঙ্গলবারের ঘটনা প্রসঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এলাকায় পুলিশি টহল চলছে। তা আরও বাড়ানো হবে। গ্রেফতার করা হয়েছে মূল অভিযুক্ত-সহ দু’জনকে। কিন্তু পুলিশ যা-ই বলুক, দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য নিয়ে বাসিন্দাদের আশঙ্কা যে মিথ্যা নয়, মঙ্গলবার রাতের ঘটনা তার প্রমাণ।
বামনগাছির প্রতিবাদী যুবক সৌরভ চৌধুরীর খুন সহ বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদে শহরে
সভা ডেকেছিলেন বিশিষ্ট জনেরা। বুধবার অ্যাকাডেমির সামনে সেই সভার মঞ্চে বক্তব্য রাখছেন
কামদুনির শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। এই দিনের এই প্রতিবাদী সভায় সৌরভের দাদা সহ
বামনগাছি থেকে প্রায় শতাধিক মানুষ যোগ দিতে আসেন। —নিজস্ব চিত্র।
বছর পঁচিশের শ্রীকান্ত জানান, রাত ১০টা নাগাদ সৌরভের বাড়ি থেকেই ফিরছিলেন তিনি। বামনগাছি স্টেশনে তখন সপার্ষদ বসে আছে আমজাদরা। শ্রীকান্তকে দেখে তারা এগিয়ে আসে। শুরু হয় চড়-থাপ্পর। আমজাদরা বলে, “খুব বাড় বেড়েছিস। প্রতিবাদী হয়েছিস।”
কোনও রকমে দুষ্কৃতীদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসেন ব্যায়াম করা সুঠাম চেহারার শ্রীকান্ত। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ স্টেশনের কাছেই শ্রীকান্তের বাড়িতে ফের চড়াও হয় আমজাদ আর তার দলবল। বছর পাঁচেক আগে ওই যুবকের বাবা মারা গিয়েছিলেন ট্রেন দুর্ঘটনায়। তারপর থেকে মা মানসিক ভাবে সুস্থ নন। সে জন্যই দিন পনেরো আগে বাড়ির সামনে মদের আসর বসানো, হই হুল্লোড় করা নিয়ে আমজাদদের নিষেধ করেছিলেন শ্রীকান্ত। অভিযোগ, সে সব প্রসঙ্গ টেনে চিৎকার করতে করতে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে আট-দশ জন। শ্রীকান্ত তাদের হাতে-পায়ে ধরে বলেন, “মা অসুস্থ। চোখের সামনে এ সব দেখলে হয় তো আর প্রাণেই বাঁচবেন না।” এরপরেই ওই যুবককে টানতে টানতে বাইরে এনে শুরু হয় কিল-চড়-লাথি-ঘুষি।
তৃণমূলের মিছিল। বুধবার বামনগাছিতে। ছবি: সুদীপ ঘোষ
নিম্নাঙ্গে চোট লেগে বমি শুরু হয় তাঁর। ছেলের বিপদ বুঝে শ্রীকান্তের মা-ও ঘরে গোঙাতে শুরু করেছেন তখন। ওই অবস্থায় শ্রীকান্তকে ফেলে রেখে চম্পট দেয় হামলাকারীরা। শ্রীকান্ত যোগাযোগ করেন সৌরভের দাদা সন্দীপের সঙ্গে। অভিযোগ দায়ের হয় দত্তপুকুর থানায়। গ্রেফতার করা হয় আমজাদ ও তার এক সঙ্গী বিশ্বজিৎ বিশ্বাসকে।
প্রতিবাদী। নিহত সৌরভ চৌধুরীর দাদা সন্দীপ। রাজ্য জুড়ে হিংসার
বিরুদ্ধে জনসভায়। বুধবার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে।—নিজস্ব চিত্র
রাতে বারাসত জেলা হাসপাতালে শ্রীকান্তর চিকিৎসা করানো হয়। হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামী তথা তৃণমূল নেতা খালেক পেয়াদা। তাঁর বক্তব্য, “কার প্রশ্রয়ে কারা এ সব করছে, সবই সাধারণ মানুষ ও পুলিশ জানে। এ নিয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।”