Arjun Singh Somnath Shyam

‘গ্যাংস অফ ব্যারাকপুর!’ অর্জুনের বিরুদ্ধে হঠাৎ উঠে এলেন সোমনাথ? শিল্পাঞ্চল জানে, শিকড় আরও গভীরে

বিষয়টিকে তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরের দ্বন্দ্বের ‘ব্যারাকপুর সংস্করণ’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। ব্যারাকপুর সিংহ ও শ্যামের যে ‘লড়াই’ দেখা যাচ্ছে, তার শেষ কোথায়, তা-ও হলফ করে কেউ বলতে পারছেন না।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫৯
Share:

(বাঁ দিকে) অর্জুন সিংহ। সোমনাথ শ্যাম (ডান দিকে)। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

তিনি সত্যিই ‘বাহুবলী’! চোখে বড় রোদচশমা, সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, সাদা জুতো, সাদা স্ট্র্যাপের সাদা ডায়ালের হাতঘড়িতে তিনি ‘দবং’ও বটে। তিনি দলবদল করে ২৯ দিনের মধ্যে লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন। তিনি অর্জুন সিংহ।

Advertisement

এ হেন অর্জুনের বিরুদ্ধে রোজ বাণ ছুড়ছেন সবে পৌনে তিন বছরের বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম! কী ভাবে? কোন সাহসে? কে তিনি? তাঁর নেপথ্যে কে বা কারা? অর্জুনের উপর যে ‘রাগ’ সোমনাথের কথায় ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে, তা কি নতুন? না কি তার শিকড় অনেক গভীরে? তার ইতিহাস প্রাচীন?

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে খোঁজ নিলে জানা যাচ্ছে, নতুন নয়। পুরনো দ্বন্দ্বই নতুন মোড়কে এসে হাজির হয়েছে।

Advertisement

স্থানীয় স্তরে বরাবরই ‘অর্জুন বিরোধী’ রাজনীতি করেছেন সোমনাথ। ছিলেন কংগ্রেসের স্থানীয় স্তরের নেতা। তাঁর মা রেবা রাহা দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস কাউন্সিলর। এখন তিনি ভাটপাড়া পুরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান। যে ভাটপাড়ার চেয়ারম্যান এক সময়ে ছিলেন অর্জুন। তিনি সাংসদ হওয়ার পর তাঁর ভাইপো সৌরভ সিংহও চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।

অর্জুনের সঙ্গে সোমনাথের দ্বন্দ্বের মূল কারণ কী? শিল্পাঞ্চলের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের বক্তব্য, মিলের শ্রমিকদের ঠিকাদারি নিয়েই গন্ডগোলের সূত্রপাত। মেঘনা জুটমিলের নিয়ন্ত্রণ যেমন অর্জুনের হাতে, তেমনই অ্যালায়েন্স জুটমিল সোমনাথের ‘দখলে’। এলাকার লোকেরা জানেন, অর্জুন বিরোধিতার রাজনীতিকে পুঁজি করে মূলস্রোতে এসে পড়েছিলেন সোমনাথ। ফলে ২০১৯ সালে অর্জুন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই সোমনাথ যান তৃণমূলে। ঘটনা পরম্পরা দেখিয়েছিল, অর্জুন যে দিন বিজেপিতে যোগ দিলেন, ঠিক তার পর দিনই তৃণমূলের তৎকালীন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে জোড়াফুল আঁকা পতাকা নিচ্ছেন সোমনাথ।

লোকসভা ভোটের টিকিট না-পেয়ে অর্জুন বিজেপিতে চলে যাওয়ায় এলাকায় আরও ‘অর্জুন’ দরকার হয়ে পড়েছিল তৃণমূলের। স্বভাবতই, যাঁরা অর্জুন বিরোধিতার রাজনীতি করতেন, তাঁদের সকলরেই গন্তব্য হয়ে উঠেছিল তৃণমূল। তার আগে পর্যন্ত তাঁদের তৃণমূল করার সুযোগ ছিল না। কারণ, ‘প্রাচীর’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বয়ং অর্জুন।

ফলে ‘প্রাচীর’ হটে যাওয়ার পরে শুধু কংগ্রেসের সোমনাথ নন, সিপিএম নেতা জিতেন্দ্র সাউও যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। সমীকরণ একই— অর্জুন বিরোধী রাজনীতি। কিন্তু লোকসভা ভোটে তাঁরা কেউই অর্জুনের জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে উঠতে পারেননি। দলবদল করে অর্জুন শুধু যে তৃণমূলকে হারিয়ে জিতেছিলেন, তা-ই নয়, তৃণমূলকে দেখাতেও পেরেছিলেন যে, তাঁকে টিকিট না দেওয়াটা ভুলই হয়েছিল। কালক্রমে বিজেপির অর্জুনের মাথার উপর চেপেছে রাজ্য পুলিশের মামলার ‘বোঝা’। আর মন দিয়ে তৃণমূল করে গিয়েছেন সোমনাথ। ‘জমি’ শক্ত করেছেন নিজের। ২০২১ সালে সোমনাথকে জগদ্দল বিধানসভায় প্রার্থী করে তৃণমূল। ভাটপাড়ায় জোড়াফুলের প্রার্থী হন সিপিএম থেকে আসা জিতেন্দ্র। যাঁকে এলাকার মানুষ ‘জিতু’ নামে চেনেন। জিতু পরাস্ত হন বিজেপি প্রার্থী তথা অর্জুন-পুত্র পবনের কাছে। কিন্তু সোমনাথ জিতে নেন জগদ্দল।

বিধায়ক হওয়ার পর এলাকায় দাপট বাড়তে থাকে সোমনাথের। অর্জুন বিরোধিতার সমীকরণেই পাশে পেয়ে যান অনেককে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রাজনীতি সম্পর্কে অবহিতদের অনেকেরই বক্তব্য, সোমনাথ এখন যা যা বলছেন, তার একটা নকশা রয়েছে। সেই নকশা দেখে মনে হচ্ছে, এর নেপথ্যে রয়েছেন এক মন্ত্রী এবং আশপাশের এলাকার কয়েক জন তৃণমূল বিধায়ক। যাঁরা দলের মধ্যে অর্জুনের ‘বিরোধী’ বলেই পরিচিত। অর্জুন তৃণমূলে ফেরার পর থেকেই পুরনো সংঘাত নতুন ভাবে ফিরে এসেছে। বস্তুত, এর আগে স্থানীয় স্তরে নানাবিধ সংঘাত দেখা গিয়েছে। একই অনুষ্ঠানে অর্জুন, সোমনাথ দু’জনে আমন্ত্রিত থাকলে দেখা গিয়েছে অর্জুন মঞ্চে আছেন দেখে ওঠেননি সোমনাথ। কিন্তু দলীয় স্তরে এমন সরাসরি সংঘাত এর আগে দেখা যায়নি। তা-ও এমন একটা সময়ে, যখন লোকসভা ভোট আসন্ন।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে বরাবর ‘পেশিশক্তি’ কাজ করেছে। সেই সঙ্গে কাজ করেছে পাটের কাঁচা টাকাও। সিপিএম জমানায় সাংসদ তড়িৎ তোপদারের বিরুদ্ধে ‘গুন্ডা পোষা’র অভিযোগ করতেন বিরোধীরা। আবার জমানা বদলের পর বামেরা বলেছে, যারা গুন্ডামি করত, তারাই নেতা হয়ে গিয়েছে! তবে ২০১৯ সাল পরবর্তী ব্যারাকপুরের রাজনীতিতে যে লাগাতার হিংসা, সন্ত্রাস, রক্তপাত এবং মৃত্যু দেখা গিয়েছে, তেমন শেষ কবে হয়েছে, তা অনেকেই মনে করতে পারছেন না।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচি ছিল নৈহাটিতে। তৃণমূলের জমানাতেই ‘ঘরছাড়া’ তৃণমূলকর্মীদের ঘরে ফেরাতে সেখানে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যা রাজ্যে তৃণমূল জমানায় ‘বিরল’ ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী গিয়ে নিজের হাতে তালা খুলেছিলেন বন্ধ তৃণমূল পার্টি অফিসের। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বার রাজ্যের ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মধ্যে এমন ঘটনা বলে দিয়েছিল, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রাজনীতি রাজ্যের অন্যান্য এলাকার চেয়ে আলাদা। যেমন ব্যারাকপুরের লাগোয়া ভাটপাড়া থানা উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময়ে মুড়িমুড়কির মতো বোমাবাজির খবর পেয়ে মাঝপথ থেকে কনভয় ঘুরিয়ে ফিরতে হয়েছিল রাজ্য পুলিশের তৎকালীন ডিজি বীরেন্দ্রকে। বার বার ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার বদলালেও আইনশৃঙ্খলার ছবি খুব একটা বদলায়নি।

বিজেপির অনেকেই মনে করেছিলেন, ২০২১ সালের ভোটেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতো ম্যাজিক দেখিয়ে শিল্পাঞ্চলের বহু আসনে পদ্ম ফোটাবেন অর্জুন। কিন্তু তা হয়নি। ভাটপাড়া বাদ দিয়ে ওই তল্লাটে কোনও আসনে জয় পায়নি গেরুয়া শিবির। অতঃপর ২০২২ সালের অগস্টে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে গিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন অর্জুন।

সেই থেকেই শুরু ‘দ্বন্দ্ব’। সেই দ্বন্দ্বই এখন এসে পড়েছে প্রকাশ্যে। সাংসদ অর্জুন বলছেন, তিনি ফেরায় সোমনাথদের ‘লুটের রাজনীতি’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে! তাই তাঁর উপর রাগ। আর বিধায়ক সোমনাথের লোকজন পাল্টা বলছেন, ‘‘মমতাদিই তো বলে গিয়েছিলেন অর্জুন ক্রিমিনালদের হেডমাস্টার!’’ সাম্প্রতিক অর্জুন-সোমনাথ বিবাদ বেধেছে একটি খুনের ঘটনায়। যার পর থেকে যুধুধান দুই নেতা পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিচ্ছেন। কাউকে থামানো যাচ্ছে না। বিবাদ এতটাই ধারালো যে, সম্প্রতি তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর ডাকা ‘মীমাংসা বৈঠকে’ যানওনি সোমনাথ। বলেছেন, বৈঠক ডাকা হয়েছে বলেই তিনি জানতেন না! যদিও অর্জুন শিবিরের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি। তাদের মতে, ‘সাহস’ পেয়েই বক্সীর বৈঠককে পাত্তা দেননি সোমনাথ। নইলে প্রথম বারের বিধায়ক অর্জুনের মতো পোড়খাওয়া সাংসদের বিরুদ্ধে (পাশাপাশি, দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধেও) টক্কর নিতে যেতেন না।

গোটা বিষয়টিকে তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের ‘ব্যারাকপুর সংস্করণ’ হিসেবেই দেখছেন অনেকে। কিন্তু কেউই হলফ করে বলতে পারছেন না যে, এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়! বরং মনে করছেন, লোকসভা ভোটের সময়ে নানা কারণ এবং সমীকরণে তার পারদ আরও চড়তে পারে। শেষবেলায় কোনও ‘অঘটন’ না ঘটলে ব্যারাকপুর লোকসভা আসনে অর্জুনকেই টিকিট দেবে তৃণমূল। তখন সোমনাথের ভূমিকা কী হবে? দেখার জন্য তাকিয়ে থাকবে শিল্পাঞ্চল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement