সিঙ্গুরে সোমেন মিত্রর খামার বাড়ি। — নিজস্ব চিত্র
ফটকে কলিং বেল নেই। বার দুই টোকা দিতেই লোহার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন কেয়ারটেকার। গেট দিয়ে ঢুকে দু’কদম এগিয়ে বাঁ দিক থেকে ডান দিক চোখ বুলিয়ে নিলেই এক লপ্তে মেপে নেওয়া যায় গোটা ছবিটা। একেবারে বাঁ দিকে শাকসব্জি ফলানোর জন্য ছেড়ে রাখা বেশ খানিকটা জমি। তার ডান দিকে দোলনা লাগানো সাজানো বাগান। পিছনে বড় পুকুর। মাঝ বরাবর প্রমাণ সাইজের একটি দোতলা বাড়ি। তারও ডান দিকে ফুলগাছের চারা তৈরি করার বাগান।
‘‘গেল হপ্তায় ‘দাদাবাবু’ এসেছিলেন। এখন নেই।’’— তাই আর ভিতরে যে ঢোকা যাবে না, কেয়ারটেকারই সাফ জানিয়ে দিলেন।
সিঙ্গুরের একদা অধিগৃহীত জমি থেকে কলকাতার দিকে কিলোমিটার খানেক এগোলেই ২ নম্বর জাতীয় সড়ক লাগোয়া এই বাগানবাড়ি। হিসেব মতো ‘দাদাবাবু’র মালিকানায় রয়েছে ২ একর ১৮ শতক জমি (দাগ নম্বর ৬৭৫ ও ৪৩৫, খতিয়ান নম্বর ২১৫, ১২০৭)। লাগোয়া ১১ বিঘা জমি আবার রয়েছে দাদাবাবুর স্ত্রীর নামে। ২০০৬ সালে ঠিক যে সময় বাম সরকার টাটার ‘ন্যানো’ গাড়ির কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু করে, তখনই কিনেছিলেন জমিটা।
‘দাদাবাবু’ মানে শিয়ালদহের প্রবাদপ্রতিম ছোড়দা! কংগ্রেস নেতা তথা ডায়মন্ড হারবারের প্রাক্তন সাংসদ সোমেন মিত্র। তাঁর ঘনিষ্ঠদের একাংশ বলছেন, ‘‘ছোড়দা ভেবেছিলেন, টাটার কারখানা হলে ওখানে হোটেল বা রিসর্ট গোছের কিছু বানাবেন। কিন্তু সে সব কিছুই না হওয়ায় এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝে মধ্যে এসে দু’চার দিন সেখানে থাকেন। পটল, ঝিঙে, শশা চাষও হয়।’’
বিনিয়োগে ‘ফেরত’ বলতে ওটুকুই। যদিও ইতিহাস বলছে, সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের সহমর্মী হিসেবেই একদা তৃণমূল নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সোমেনবাবু! পরে দলত্যাগী হয়ে তৃণমূলের টিকিটে লোকসভাতেও যান। সোমেনবাবু অবশ্য দাবি করছেন, ওই জমিতে হোটেল নয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু সে সব হয়ে না ওঠাতেই বাগানবাড়ি করেছেন।
‘দাদাবাবু’ একা নন। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে সিঙ্গুরের পরিত্যক্ত কারখানার জমির আশপাশে। একটু খোঁজখবর করলেই জানা যাচ্ছে, টাটাদের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হতেই প্রকল্প এলাকার আশপাশে বিঘার পর বিঘা জমি কিনে ফেলেছিলেন কিছু শিল্পপতি-ব্যবসায়ী এমনকী নেতারাও। এঁদের অনেকেরই পরিচিতি ছিল সিপিএম-ঘনিষ্ঠ হিসেবে। স্থানীয়রা বলছেন, জমি কিনে কারও লক্ষ্য ছিল ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা’। অর্থাৎ বাজার তেজি হলে ওই জমি চড়া দামে বেচে দেওয়া। কেউ আবার ভেবেছিলেন, টাটার কারখানা পত্তন হলে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতি হবে। এলাকার পরিকাঠামোও বাড়বে। তখন ওই জমিতে বাজার বুঝে কারখানা বা অন্য কোনও পরিষেবা খুলবেন।
কিন্তু সাত মণ তেল পুড়লেও রাধা নাচেনি! উল্টে সিঙ্গুরের অধিগ্রহণকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সেই রায়ের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন, জমি চাষযোগ্য করে চাষিদের ফেরত দেবেন তিনি। ফলে এখনই সেখানে কোনও শিল্প-সম্ভাবনা নেই। আবার জমি আদৌ চাষের অনুকূল করে তোলা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে স্থানীয় চাষিরাও সন্দিহান।
প্রশ্ন হল, অতি উৎসাহে কিনে ফেলা এই জমিগুলির সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ কী?
সিঙ্গুরের তৃণমূল নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী বেচারাম মান্নার দাবি, ওই সমস্ত জমি যাঁরা কিনেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন জমিগুলি স্রেফ ফেলে রেখেছেন। আধখানা ইটও গাঁথা হয়নি, এমন উদাহরণও আছে। কয়েক জন আবার কেনা দামেই বেচে দিয়েছেন। বেচারামের কথায়, ‘‘টাটা প্রকল্পের কথা চাউর হতেই সিঙ্গুরে জমি কেনার হিড়িক পড়েছিল। সেই হুজুগের তালিকায় যেমন ছোটখাটো ব্যবসায়ী ছিলেন, তেমনই ছিলেন কলকাতার অনেক নামজাদা রথী-মহারথী।’’
স্থানীয় উদয়ন দাস অবশ্য ঠিক ‘ছোট ব্যবসায়ী’ নন। তাঁর ভাবনায় ছিল একটি ওই এলাকায় একটি ‘বহুমুখী হিমঘর’ তৈরি এবং তা ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করা। সিঙ্গুরে ভাল সব্জি হয়, অথচ তা সংরক্ষণের জন্য কোনও হিমঘর ছিল না। কিন্তু বিধি বাম। হিমঘরটি পড়ে যায় টাটাদের প্রকল্প এলাকার মধ্যে। কোনও ভাবেই সেটিকে প্রকল্পের মানচিত্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়নি। তাই হিমঘর চালু করেও শুরুতেই তা গোটাতে হয় উদয়নবাবুকে। এর পর তিনি প্রকল্প এলাকার ঠিক উল্টো দিকে তালাভোমরা মৌ়জায় একলপ্তে মোট ১৩ একর জমি কিনেছিলেন। কিন্তু তা নিয়েও যে আপাতত আশা দেখছেন না, শনিবার উদয়নবাবুর কথাতেই সেটা স্পষ্ট। তিনি বললেন, ‘‘চেয়েছিলাম ওই জমিতে সব্জির কোল্ড চেন তৈরি করব। টাটারা চলে যাওয়ায় এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন সেই ভাবে হল কোথায়? জল নিকাশি, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন— কিছুই হয়নি। আপাতত তাই অপেক্ষার দিন গোনা চলছে।’’
আরও পড়ুন: বাঙালি দুর্গা পূজা নতুন রূপে নতুন সাজে
ফ্যাশানিস্তারা পুরো দুনিয়া জুড়েই পালাজোতে মেতে
অথচ টাটাদের ‘ন্যানো’ প্রকল্প ঘোষণার পর দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া এলাকায় যে হারে জমির হাতবদল হয়েছিল, তাতে একটা সময়ের পরে দেখা গিয়েছিল, পুরনো জমি-মালিকদের চেয়ে সেখানে নতুনদের সংখ্যাই বেশি। ২০০৬ সালে এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া জমির দাম ছিল কাঠা-প্রতি ১২ হাজার টাকা। সেটাই এখন ২০ লক্ষ। কিন্তু পরিকাঠামোহীন সিঙ্গুরে এই টাকায় জমি কেনার ক্রেতা আপাতত নেই। উল্লেখযোগ্য নামেদের মধ্যে এক মাত্র চন্দন বসুই তাঁর জমিটি বিক্রি করতে পেরেছেন বলে জানা গিয়েছে। ‘নতুন’ জমি মালিকদের সিংহভাগই এখন চরম ফ্যাসাদে।
উদয়নবাবুর মতোই টাটাদের প্রকল্পের উল্টো দিকে সিংহের ভেড়ি মৌজার লাগোয়া বেশ কিছু জমি রয়েছে সিঙ্গুরের হিমাদ্রি কেমিক্যালসের। সংস্থার মালিকেরা ভেবেছিলেন, টাটার কারখানা শুরু হওয়ার পর সিংহের ভেড়িতে নিজেদের কারখানার সম্প্রসারণ করবেন। সেই সম্ভাবনাও এখন শিকেয়। বেগমপুরের এক আইনজীবী পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৬০ বিঘা জমি কিনে রেখেছেন। আবার সিঙ্গুর-লাগোয়া জয়মোল্লায় একটি কাগজের মিল কর্তৃপক্ষ জমি কিনে ফেলেছিলেন অন্তত ১০০ বিঘা। তাঁরাও এ পর্যন্ত সেখানে কোনও প্রকল্প তৈরিতে উদ্যোগী হননি। এ ছাড়া জয়মোল্লার পাশে চন্দনপুরে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি সংস্থা এক লপ্তে অনেকটা জমি কিনে রেখেছে। সেখানেও আগাছা বেড়ে এক কোমর।
অগত্যা উপায়?
স্থানীয়দের মতে, জমির মালিকদের একটা বড় অংশ এখনও আশা করেন, আজ না হয় কাল কোনও না কোনও বড় প্রকল্প হবে সিঙ্গুরে। আসবে বড় কোনও শিল্প গোষ্ঠী। তেমন কিছু ঘটলে পরিকাঠামোর হয়তো উন্নতি হবে। ফিরবে বরাত।
যদ্দিন তা না হচ্ছে, শশা চাষই হোক!