হয় অবহেলা নয় দোষারোপ, শেরপাদের জন্য বঞ্চনার শৃঙ্গ

পরপর অভিযাত্রীর মৃত্যুর খবরে শোক নেমেছে তাঁদের পরিবারগুলিতে। সাধারণ মানুষ জেনেছেন, পাশে থেকেছেন। কিন্তু শোকার্ত তো ওঁরাও। প্রিয়জনকে হারানোর হাহাকারে ভরেছে ওঁদের ঘরও। শুধু পা পড়েনি লাইট-ক্যামেরা-মাইকের। তাই সাধারণ মানুষও জানেনি এঁদের কথা।

Advertisement

রেজা প্রধান

দার্জিলিং শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০৩:৩৭
Share:

ফ্রে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে আর ফেরেননি আং ও দাওয়া।

Advertisement

পরপর অভিযাত্রীর মৃত্যুর খবরে শোক নেমেছে তাঁদের পরিবারগুলিতে। সাধারণ মানুষ জেনেছেন, পাশে থেকেছেন। কিন্তু শোকার্ত তো ওঁরাও। প্রিয়জনকে হারানোর হাহাকারে ভরেছে ওঁদের ঘরও। শুধু পা পড়েনি লাইট-ক্যামেরা-মাইকের। তাই সাধারণ মানুষও জানেনি এঁদের কথা।

ওঁরা শেরপা। পাহাড় পথের বন্ধু। অভিযাত্রীর কাছে ‘ভগবান’। সেই ভগবানদের সঙ্গে নিয়েই অভিযাত্রীরা ছুঁয়ে ফেলেন একের পর এক শৃঙ্গ। বিনিময়ে মেলে সারা বছর সংসার চালানোর অর্থ। কিন্তু খ্যাতির পালক? এঁদের জন্য নয়। তবে বিপদের আঁচ অভিযাত্রীর গায়ে লাগলে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় বিলকুল।

Advertisement

এভারেস্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, বিভিন্ন বড় শৃঙ্গ অভিযানে দুর্ঘটনার সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই ভয় পাচ্ছে শেরপা পরিবারগুলি। অভিযানে কোনও সমস্যা ঘটলেই সমতল থেকে অভিযোগের আঙুল ওঠে শেরপাদের দিকে। উড়ে আসে তির্যক মন্তব্যও। যেন ‘শেরপা’ চাইলেই বাঁচাতে পারতেন অভিযাত্রীদের। যেন চাননি, তাই বাঁচেননি অভিযাত্রী!

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাহাড়-বন্ধুর ভূমিকা পালন করে আসা মানুষগুলো তাই চাইছেন, তাঁদের আগামী প্রজন্ম যেন আর এই পেশায় না আসে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরোহীর সঙ্গী হোক বাড়ির সন্তানেরা, সেটা আর চান না তাঁরা।

৩৮ বছরের ন্য দোর্জি লেপচা। দার্জিলিঙের লম্বাদারার বাসিন্দা। বললেন, ‘‘২০০৬ থেকে শেরপা হিসেবে কাজ করছি। প্রতি বছরই এভারেস্ট অভিযানে যাচ্ছি। তিন-তিন বার শিখর ছুঁয়েছি।’’ বলা যায় না কখন কী বিপর্যয় ঘটে। ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর নেশা থাকলেও দিনের শেষে এটাই পেশা। তাই চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বজায় রাখতে হয় পেশাদারিত্ব। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি নয়। ‘‘তবে আমি পাহাড়ে চড়তে জানি। তাই একে পেশা হিসেবে বেছেছি’’— বলতে গিয়ে একটু গর্বও যেন ঝিলিক দিল চোখে। আরোহণ মরসুমে তাঁর যা রোজগার, তার উপরেই পরিবার নির্ভরশীল। তাই কাজ চালিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু তিনি নিজে চান না, তাঁর পরিবারের কেউ এই পেশায় আসুক।

দোর্জি নিজে মৃত্যু-মুখ থেকে ফিরে এসেছেন বহু বার। দোর্জির তিন ছেলে মেয়ে। বললেন, ‘‘ওরা অন্য পেশা বেছে নিক। এটাই বোঝাই।’’

অভিজ্ঞতার গল্প বলছিলেন দু’কামরার কাঠের ঘরে বসে। গত এপ্রিলেই অন্নপূর্ণা অভিযানে গিয়েছিলেন চিনের এক আরোহীর সঙ্গী হয়ে। নিজের সমস্ত সরঞ্জাম ফেলে এসেছেন সেখানে। হঠাৎ তুষারঝড়ে ছিটকে যান তিনি। হারিয়ে যায় রুকস্যাক। ‘‘একটা ঢালে যদি আর পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছতাম, আজ এখানে থাকতাম না।’’ এ বারও এভারেস্টে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সরঞ্জামের অভাবেই বাতিল হয়েছে। প্রায় ২ লক্ষ টাকার সরঞ্জাম হারিয়েছে। একটা এভারেস্ট অভিযানে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মেলে। বছরে দু’-তিনটির বেশি অভিযান করা হয় না। সব ক’টির পারিশ্রমিক এভারেস্টের মতোও নয়।

অনেক শেরপাই বলছেন, শেরপারা না থাকলে অভিযাত্রীদের শৃঙ্গ জয় হতোই না। আরোহীরা গোটাটাই শেরপাদের উপর নিভর্রশীল। শেরপাদের দেখানো পথ ধরেই চলেন অভিযাত্রীরা। মালপত্রও শেরপারা বহন করেন। কিন্তু শৃঙ্গ ছোঁয়া হলে পর্বতারোহীদের নামই সামনে আসে। শেরপাদের নয়। ছোঁয়া না-হলে শেরপাদের দিকে আঙুল ওঠে। শেরপারা বলছেন, এটা কাম্য নয়। ‘‘কী পরিস্থিতিতে কী করা দরকার, সেটা ওপরেই অবস্থা বুঝে ঠিক হয়,’’ বলছেন দোর্জি।

২৪ বছরের আং দোর্জি শেরপার স্ত্রী ইয়াং গি শেরপা। গত বছর দক্ষিণ সিকিমের মাউন্ট ফ্রে অভিযানে গিয়ে মারা যান আং। এ দিন কান্না ভেজা গলায় ইয়াং জানালেন, তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে পরিবার চালাতে পাথর ভাঙার কাজ করেন। বললেন, ‘‘ওঁর ঝুঁকির জীবনে কতটা মাসুল গুনতে হয়, তা আমাদের চেয়ে বেশি আর কে বোঝে। আমার ছেলেমেয়েদের এই পেশায় যেতে দিতে চাই না।’’ আং যখন মারা যান, তখন গভর্বতী ছিলেন ইয়াংগি। বাবার মুখ দেখা হয়নি ছোট্ট ছেলেটার।

প্রায় একই যন্ত্রণায় বাঁচেন পেমবি লামু শেরপা। দার্জিলিঙের ঘুমে থাকেন বছর তেইশের তরুণী। সারা ঘরে ছড়ানো পর্বতারোহণের নানা সরঞ্জাম। শো-কেসে সাজানো বিভিন্ন প্রশিক্ষণের শংসাপত্র। দেওয়ালের ছবিতে একমুখ হাসি। সব আছে, শুধু ফিরে আসেননি আসল মানুষটা। ২০১৪ সালে ছন্দা গায়েনের কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে সঙ্গী ছিলেন পেমবির স্বামী দাওয়া ওয়াংচুক শেরপা। কাঞ্চনজঙ্ঘার পরে ইয়ালুং কাং চড়তে গিয়ে হারিয়ে যান ছন্দার সঙ্গেই। ২০১৩ সালে ধৌলাগিরি অভিযানে গিয়ে যখন বিপদের মুখে পড়েছিলেন প্রথম অসামরিক বাঙালি এভারেস্টজয়ী বসন্ত সিংহরায়, দাওয়া-ই বাঁচিয়ে ফিরিয়েছিলেন তাঁকে। জানতে পারেনি কেউ।

পেমবির ভাই নরবু-ও পেশায় শেরপা। বহু শৃঙ্গ ছুঁয়েছেন। তবে দাওয়ার মৃত্যুর পর থেকে ভাইকে আর বড় অভিযানে যেতে দেন না পেমবি। পারিবারিক পেশা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেছেন নরবু।

একই রকম অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন ৫১ বছরের পেনিমা শেরপা। তিনি থাকেন আলুবাড়িতে। তাঁর স্বামী, চার ভাই, দুই জামাই গাইডের কাজ করেন। ওঁর দুই মেয়েও শেরপাদের বিয়ে করেছে। ওঁরাও আতঙ্কে থাকেন। বেসক্যাম্পে ফেরার খবর না পাওয়ার অবধি রাতে ঘুম হয় না। পেনিমাও বলছেন, ‘‘অনেক হয়েছে। আমি চাই না, পরিবারের আর কেউ এই পথে হাঁটুক।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement