শঙ্খ ঘোষ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
শেষ বার নিমতলা শ্মশানে গিয়েছিলাম বড় পিসিকে নিয়ে। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে সংস্কার হওয়া শ্মশান-ঘাটে প্রায় বকেঝকেই একটা চেয়ারে বসাতে হয়েছিল জেঠুকে। কাঁদতে দেখেছিলাম।
সেই শ্মশানেই বুধবার সার সার কোভিড বডি। বড়পিসির সময়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জেঠু বলছিল, ‘‘ঘিরে রেখো ওকে।’’ কোভিড শ্মশানে হাতে হাত রেখে জেঠুকে ঘিরে থাকতে পারলাম না আমরা। এমনকি, অসুস্থতার সময়েও।
কোভিড নিয়ম উপেক্ষা করে শেষবেলায় ঘরে বসে গান শোনাতে পারলাম না। গত এক বছর ধরে কেবলই গান শুনতে চাইত আমাদের গলায়। এমনকি, ফোনেও। দিল্লিতে যখন একা কোভিডের সঙ্গে লড়াই করছি, ফোনে বলেছিল, ‘‘আবির, সারা ক্ষণ গান চালিয়ে রাখো।’’ জেঠুর কোভিডের সময় একই উপদেশ আমি দিলাম, ‘‘গান শোনো।’’ উত্তর দিয়েছিল, ‘‘অত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’’
বুধবার বিকেলে যখন পুলিশের কনভয়ে জেঠু শ্মশানের পথে যাচ্ছে, ফোন করল শ্রীজাত। বলছিল, জন্মদিনের দিন বাড়িতে গিয়েছিল। গান শুনিয়েছিল। রবিবারের ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের ঘর কোনও দিনই পছন্দের ছিল না আমার। পছন্দের ছিল না জন্মদিনটাও। বহু মানুষের ভিড়। ঠায় চেয়ারে বসে থেকে নানা রঙের মানুষের সঙ্গে জেঠুর কথা বলে চলা অথবা শুধু শোনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। সেই ঘরে ঢুকে জরুরি কিছু বলার জো ছিল না। কোভিড-সময়ে রবিবারের আড্ডায় ছেদ পড়েও পড়েনি। যে যখন পেরেছে গিয়েছে। সেই নিয়ে রাগারাগি করেছি সবাই। পাত্তা দেয়নি। সকলকে না দেখলে মনখারাপ করত খুব। বাবার মতোই জেঠুরও পছন্দ ছিল না আমি কলকাতা ছেড়ে দিল্লি চলে যাই। আমার কোভিডের পরে সে কথা বলেওছিল এক বার।
গানের কথায় একটা অন্য অনুষঙ্গ মনে পড়ছে। ২০০৫ সালের ১০ জুন রাতে যাদবপুরে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর লাঠি চালিয়েছিল পুলিশ। পর দিন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আমরা ম্যাটাডর নিয়ে যাদবপুর গেলাম। সঙ্গে স্লোগান— ‘লাঠির মুখে গানের সুর, দেখিয়ে দিল যাদবপুর’। দুপুরের দিকে অসম্ভব উত্তেজিত গলায় জেঠুর ফোন, ‘‘লাইনগুলো কার লেখা? সময় মতো এক বার দেখা করিস।’’ সেই দুপুরেই যাদপুরের কিছু বন্ধুকে নিয়ে পৌঁছলাম ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস। সঙ্গে একটা সিডি-তে আগের রাতের ফুটেজ। ছবি দেখে ঠকঠক করে কাঁপছিল জেঠু। কাঁদতে দেখেছিলাম সে দিনও।
মনে নেই, সেই বিকেলেই, নাকি পরের দিন যাদবপুরের ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। ঠিক যেমন নন্দীগ্রামের পর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলাকালীন নন্দনে আন্দোলনরত মানুষদের লালবাজারে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পৌঁছে গিয়েছিল পুলিশ সদর দফতরের মূল ফটকে। তত দিনে আমি সাংবাদিক। ‘বাইট’ শিকার শিখে গিয়েছি। টিভি চ্যানেলের বুম বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিছু বলবে? ৩৬ বছরে অত রাগ করতে দেখিনি কখনও।
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।
বুধবার সকালে ভিডিয়ো কলে সাত্যকি’দাকে যখন জেঠুর নিথর চেহারাটা দেখাচ্ছিলাম, উনি যখন বলছিলেন চোখটা খুলে দেখাতে, খুব রাগী লাগছিল জেঠুকে। তার পর আর মুখ দেখার সুযোগ হয়নি। ইচ্ছেও করেনি।
কিছু অপছন্দ হলে বকুনি খেয়েছি অনেক। বড়জেঠু সত্যপ্রিয় ঘোষকে নিয়ে গবেষণা করছিলেন এক পরিচিত। দায়িত্ব পড়েছিল তাঁকে নিয়ে কলাবাগান যাওয়ার। দেশভাগের পর কলাবাগানের বাড়িতে এসে উঠেছিল বড়জেঠু আর গোটা পরিবার। বস্তির ভেতর পাঁচতলা সেই রেলের বাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে জীবন্ত জীবাশ্মের মতো। ঠা-ঠা গরমে সেই বাড়ি যাব শুনে নাছোড়বান্দা জেঠু। যাবেই আমাদের সঙ্গে। কলাবাগানের কলপাড়, ছাদের ঘর, এক কামরার ঠাঁই— স্মৃতিতে এ ভাবে কখনও হাত বোলাতে দেখিনি কাউকে। বার তিনেক নীচ থেকে ছাদ, ছাদ থেকে নীচ, জড়ানো-জাপ্টানো গলি পেরিয়ে আধাখ্যাঁচড়া কলেজস্ট্রিট মার্কেটের সামনে যখন পৌঁছলাম, জেঠু তখন টলছে। রাস্তার উপর পড়ার উপক্রম যখন, দুই পথচারী সাহায্য করলেন ধরতে। তত ক্ষণে চোখ উল্টে গিয়েছে। অনেক ক্ষণ ধরে জল দেওয়ার পর যখন সম্বিত ফিরল, গাড়ির এসি তখন ফ্রিজের মতো। রফা হল— বাড়ি গিয়ে জেঠিমাকে কিছু বলা যাবে না। ডাক্তারের সঙ্গে কথাও সেরে নিতে হবে গাড়িতেই। কথার খেলাপ হয়েছিল। উল্টোডাঙায় যখন পৌঁছলাম, দিদিরা চলে এসেছে। জেঠিমা উদ্বিগ্ন। খাটে বসার আগে বারান্দায় ডেকে নিয়ে বকুনি দিয়েছিল।
শীতের দুপুরে রোদবারান্দায় পাখি আসত অনেক। জেঠু বলত দেশের গল্প। পুজোর সময় দেশের বাড়ি গিয়ে ওদের প্রথম কাজ ছিল কার্তিক দেখা। এ বার বাবু, নাকি সেনাপতি! আর হত নবান্ন। বেশ কয়েক বছর আগে আমরা ভাইবোনেরা ঠিক করলাম, এ বার কলকাতাতেই নবান্ন হবে। গোটা পরিবার নিয়ে। খাওয়া হবে সেই সব পদ, দেশের বাড়িতে যেমন হত। যথারীতি পিসি-জেঠুদের ঝগড়া লাগল। দিদা কোন রান্নায় কী দিত তা নিয়ে সকলেরই একেকটা নিজস্ব মত। শেষ পর্যন্ত রাত জেগে চার্ট বানানোর কাজ পড়ল আমাদের। দেশের বাড়ির নবান্নের স্মৃতি ভরানো হয়েছিল ওই সব চার্টে। নেতৃত্বে ছিল জেঠুই। প্রতিটা খুঁটিনাটি নিয়ে খুঁতখুতুনি এত বেশি ছিল, যে প্রতিটা চার্ট তৈরি করতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। খুঁতখুতুনি ছিল মিষ্টি নিয়েও। নকুড়ের সন্দেশ। বাড়িতে কেউ এলে প্লেটে নকুড়ের সন্দেশের কানা ভাঙা থাকলে সকলকে বকুনি খেতে হত। সত্যি, কত বার যে বকুনি খেয়েছি!
বুধবার সকালে জেঠুর উল্টানো দু’চোখ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, অন্তত বকুনি দেওয়ার জন্য এক বার খুলতে পারছে না!