লড়াই এখন বীজতলা (ধান-চারা যা অন্যত্র তৈরি করে চাষের মূল জমিতে পোঁতা হয়) তৈরি করা বা বাঁচানোর। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোয় বৃষ্টি নামমাত্র বা অপর্যাপ্ত। এই অবস্থায় আমন ধানের বীজতলা তৈরি করতে বা বাঁচাতে সমস্যায় পড়ছেন চাষিরা। কৃষি-কর্তা ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এখনও বৃষ্টির ঘাটতি মেটার সময় আছে। কিন্তু অনেক চাষিরই ধারণা, আশু বৃষ্টি না হলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।
পূর্ব বর্ধমানে গত মাসে বৃষ্টির ৫৭ শতাংশ ঘাটতি ছিল। এ মাসে এখনও পর্যন্ত ১৯ শতাংশ ঘাটতি। গলসির চাষি মানসকুমার হাজরা, শেখ সাহাদাত হোসেনদের দাবি, “বারবার সেচ দিয়েও বীজতলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হলে বীজতলা বাঁচানো কঠিন।’’ ভাতারের চাষি শ্যামল চৌধুরী বলেন, “পুকুরের জল সেচ করে বীজতলায় দিচ্ছিলাম।
তা-ও শেষ। এখন বীজতলা কী ভাবে বাঁচাব, জানি না।’’ আউশগ্রাম ১-২, মঙ্গলকোটের মতো জেলার যে সব ব্লকে সেচের জলের ব্যবস্থা ততটা জোরদার নয়, সেখানে পরিস্থিতি আরও জটিল। জেলা কৃষি দফতরের তথ্য আধিকারিক মহম্মদ হাকিমুল কবিরের দাবি, “সরকারি ভাবে সোমবার থেকেই ধান রোয়া শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে জেলায় চাষ শুরুই হয়নি। চাষিরা বীজতলা বাঁচাতেই ব্যস্ত।’’
হুগলিতে দামোদর, মু্ণ্ডেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর, কানা নদী থেকে চাষজমিতে সেচের জল যায়। দামোদরে সামান্য জল থাকলেও অন্য নদীগুলি শুকিয়ে কাঠ। ফলে, ‘রিভার লিফট ইরিগেশন’ সম্পূর্ণ বন্ধ। ধনেখালি, তারকেশ্বর, বলাগড়, চাঁপাডাঙ্গা, জাঙ্গিপাড়া, সিঙ্গুর, পুরশুড়া—সর্বত্রই কমবেশি ভুগছেন চাষিরা। পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরেও একই ছবি। পাঁশকুড়ার সাপুকুর বাজারের বীজ বিক্রেতা বিশ্বনাথ সামন্ত বললেন, ‘‘এ বার বৃষ্টি কম হওয়ায়
আমন ধানের বীজ বিক্রি বেশ কম। যাঁরা বীজ কিনেছেন, তাঁদের অনেকেই জলের অভাবে এখনও বীজতলা
করতে পারেননি।’’
জুন থেকে জুলাইয়ের ১৫ তারিখ পর্যন্ত যেখানে গড়ে ৩২৪.৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেখানে সোমবার পর্যন্ত বীরভূমে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৮৩.০৪ মিলিমিটার। এই পরিস্থিতিতে জেলায় এখনও পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশ বীজতলাও তৈরি করা যায়নি। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সৌজন্যে পুরুলিয়া, বাঁকুড়াতে কিছুটা বীজতলা হয়েছে। কিন্তু জলের অভাবে ধান রোয়া প্রায় শুরুই করতে পারেননি চাষিরা। অন্য বছর জুলাইয়ের মাঝামাঝির মধ্যে বাঁকুড়ায় অন্তত ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান রোয়া হয়। এ বছর
এখনও পর্যন্ত ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান রোয়া গিয়েছে।
তবে বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট না হওয়ায় পূর্ব মেদিনীপুরের পানচাষি এবং পূর্ব বর্ধমানের আনাজ চাষিরা খুশি।
প্রাক্তন কৃষি-কর্তা তথা কৃষি-বিজ্ঞানী স্বদেশ মিশ্র জানাচ্ছেন, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে উত্তরবঙ্গে অতিবর্ষণ ঘটলেও, দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির এই বিরতি এ রাজ্যে নতুন নয়। তাঁর বক্তব্য, অগস্টের গোড়ায় বীজতলা রোপণের পরে বৃষ্টি হলেও আমন চাষে জলের ঘাটতি পুষিয়ে যাবে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক মহাদেব প্রামাণিক জানাচ্ছেন, অগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমন ধান রোয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদারেরও দাবি, ‘‘জুলাই মাসের শেষ অংশটা বীজতলা জমিতে বসানোর পক্ষে আর্দশ সময়। তখনই জলের প্রয়োজন বেশি। তাই এখনও কিছুটা অপেক্ষা করা যাবে।’’
কিন্তু চাষিদের একটা বড় অংশের ধারণা, জুলাইয়ের শেষ দু’সপ্তাহে নিয়মিত বৃষ্টি হলে কোনও মতে বীজতলা বাঁচবে। কিন্তু আমন চাষে দেরি হবে। ফলে, সাব-মার্সিবল পাম্প ব্যবহার করতে হবে চাষিদের। তাতে চাষের খরচ বাড়বে, ফলনও প্রত্যাশিত মাত্রায় হবে না।
সেই দেরির প্রভাব পড়বে রবি মরসুমে। ঠিক সময় পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে আমন ধান অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে কাটা হয়ে যেত। নভেম্বর থেকে জমি তৈরি করে বোনা হত আলু, সর্ষে। কিন্তু আমন চাষে দেরির জন্য সে প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেলে রবি মরসুমের ফসলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে। ধনেখালির চাষি কাশীনাথ পাত্র বলেন, ‘‘কয়েক দশক ধরে চাষ করছি। এমন অবস্থা কখনও দেখিনি।’’
একান্তই যদি বৃষ্টির ঘাটতি দেখা যায় তা হলে রাজ্য সরকার বিকল্প পরিকল্পনা ছকে রেখেছে বলে দাবি মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান কৃষি উপদেষ্টার। তবে সেই বিকল্প পরিকল্পনাটি ঠিক কী, তা ভাঙেননি তিনি।