দখল: সরস্বতী নদীর উপরেই নির্মাণ। ডোমজুড়ে। ছবি: সুব্রত জানা
আর মেলে না তারুই, চিতি, কাঁকড়া। আর ভাসে না ডিঙা। ‘চুরি’ হয়ে গিয়েছে ইতিহাসের সরস্বতী।
গঙ্গা ছাড়াও আর যে নদী একসময়ে দুই জেলার সমৃদ্ধির কারণ হয়ে উঠেছিল, এখন সেই সরস্বতী গতিহারা। কচুরিপানায় আবদ্ধ। কোথাও নদীর অংশ দখল করে দাঁড়িয়ে কংক্রিটের নির্মাণ, কোথাও তার ‘ডাস্টবিন’-এর চেহারা। যেখানে জলের দেখা মেলে, রং নিকষ কালো।
হুগলির ত্রিবেণীর গঙ্গা থেকে বেরিয়ে ৭৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হাওড়ার সাঁকরাইলে গিয়ে সরস্বতী ফের ওই নদীতেই মিশেছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই নদীটির কার্যত কোনও অস্তিত্ব নেই। ইতিহাস বলে, বহু শতাব্দী আগে এই নদী ছিল অন্যতম বাণিজ্যপথ। সরস্বতীর দু’ধারে অনেক মন্দির আছে। বণিকেরাই বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় ওই সব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, এমনটাই ধারণা। সেই নদী এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু কেন সংস্কার হয় না বছরের পর বছর?
সেচ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পূর্ণাঙ্গ সংস্কার অনেক টাকার ব্যাপার। এ ব্যাপারে দিল্লিতে দরবার করা হচ্ছে। কেন্দ্রের সাহায্য পেলে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হবে।’’ কিন্তু ‘সরস্বতী বাঁচাও’ আন্দোলনের চাপে এই সেচ দফতরই হুগলির নসিবপুর থেকে হাওড়ার সাঁকরাইল পর্যন্ত ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিল। ২০০৮ সালে সাঁকরাইলের দিক থেকে কাজ শুরুও হয়। কিছুটা কাজের পরে বর্ষা নামে। তারপরে সব বন্ধ।
হুগলির বাঁশবেড়িয়া থেকে আদিসপ্তগ্রাম এবং চন্দননগর থেকে চণ্ডীতলা পর্যন্ত কিছু জায়গায় সরস্বতীর জল সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। মাঝের অংশে আবার চোলাই কারবারের যাবতীয় বর্জ্যের ঠাঁই হয় নদীর বুকে। চণ্ডীতলার পর থেকে হাওড়ার আন্দুল এবং সাঁকরাইল পর্যন্ত আবর্জনা, বিভিন্ন কল-কারখানা এবং খাটালের বর্জ্য পড়ে এই নদীতে। বলুহাটি থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত অংশে নদীপাড় জবরদখল হয়ে গিয়েছে।
সরস্বতীর এই অবস্থায় ক্ষুব্ধ নদীপ্রেমী এবং পরিবেশবিদরা। তাঁরা মনে করছেন, সরকারি উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক তৎপরতা থাকলে সরস্বতী অতীত গরিমা কিছুটা হলেও ফিরে পেতে পারে। ২০০১ সাল থেকে তাঁদেরই একাংশের উদ্যোগে শুরু হয় ‘সরস্বতী বাঁচাও’ আন্দোলন। পলি তুলে নদী ও তার সংলগ্ন খাল সংস্কারের দাবি জানানো হয়। আন্দোলনকারীরা দিল্লিতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনেও যান। তারপরে নড়েচড়ে বসে রাজ্য সেচ দফতর। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘নদীটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হলে মাছ চাষ তো বটেই, ভূগর্ভস্থ জলের জোগানও বাড়বে। নদীর পাড় থেকে বেআইনি দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে। সেই সদিচ্ছা আদৌ দেখা যাবে?’’
হাওড়ার বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ শিবেন্দু মান্না বলেন, ‘‘পুথি এবং কাব্যে চাঁদ সওদাগরের সরস্বতী পাড়ি দেওয়ার কথা মেলে। এইসব পুথি পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল।’’ সরস্বতী নিয়ে গবেষণা করেছেন হাওড়ার দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী। তাঁর মতে, ‘‘মন্দিরের আধিক্য প্রমাণ করে যে, বাণিজ্যের উপযুক্ত বজরা চলাচলের উপযোগী ছিল এই এই নদী।’’ চন্দননগরের বাসিন্দা, কলেজ শিক্ষক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই নদী নিয়ে চর্চা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সরস্বতী এক সময়ে এই তল্লাটের প্রধান বাণিজ্যপথ ছিল। বাণিজ্যতরী, যাত্রী-নৌকো, জেলে ডিঙি— সবই চলত। এখন নদীর চেহারা দেখলে এ সব গল্পকথা মনে হবে।’’
চণ্ডীতলার গরলগাছার বাসিন্দা, অশীতিপর মহানন্দ ঘোষাল স্মৃতি হাতড়ান, ‘‘ছেলেবেলায় দেখেছি সরস্বতী দিয়ে নৌকো করে হরেক জিনিস আসত। কালীপুরে সে সব নামানো হত। নদীতে স্রোত ছিল। এখন তো নদী সঙ্কীর্ণ। কোথাও জল আছে, কোথাও নেই। দেখে খুব কষ্ট হয়।’’